রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৩

শাহবাগ -একটি ভালোবাসার নাম , একটি মুক্তির নাম , একটি স্বাধীনতার নাম

নিজেদের মধ্যে আমাদের সবার ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতের মিল -অমিল , তর্ক -বিতর্ক থাকবেই । দেশ টা আমাদের সবার , আমরা সবাই এই বাংলাদেশের মানুষ।এক একজন এই বাংলাদেশ টাকে নিয়ে এক একভাবে চিন্তা করবেন , এক একভাবে ভালবাসবেন , উন্নতির জন্য বিভিন্ন রকম চিন্তা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক । আমরা সবাই তো এই দেশের মানুষ , কোন রোবট তো না যে আমাদের সবার চিন্তাধারা একই রকম হবে । কিন্তু এক জায়গায় আমরা সবাই এক , আর তা হল আমরা সবাই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই , জামাত -শিবির নিষিদ্ধ চাই। এই জায়গায় সবাই এক কারন এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন , ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বদলা নেয়ার প্রশ্ন। আর আমরা যে যেভাবেই বাংলাদেশ টাকে নিয়ে চিন্তা করি না কেন , সবার প্রেরনার উৎস কিন্তু সেই একই - সংগ্রামী ইতিহাস , মুক্তিযুদ্ধ , ভাষা আন্দোলন , বঙ্গবন্ধু । এই এক ই বিন্দু থেকেই কিন্তু আমরা সবাই দেশ কে নিয়ে চিন্তা করতে বসি , এরপর বিভিন্নমুখী চিন্তা -ভাবনার উদ্ভাবন। রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে আমাদের আন্দোলনের মূলমন্ত্র টা কি ? স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে , এখন ও রাজাকার রা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে বেড়ায় , রাজাকারের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে আর বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা জেলের গাড়ি থেকে সেই দৃশ্য চেয়ে দেখেন , বীরাঙ্গনা মা , যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার ৪২ বছর পর ও সেই খুনি -ধর্ষক দের উল্লাস দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন - এসব আমরা সহ্য করতে পারছিলাম না আর। তিল তিল করে বুকের ভেতর জমতে থাকা আগুন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মত বিস্ফোরিত হয়েছিল শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে । আর সেই প্রজন্ম চত্বরের যোদ্ধারা কারা ? আমি , আপনি , আমাদের মতই সাধারন মানুষ। সেখানে মা এর হাত ধরে গিয়েছিল কিশোরী মেয়ে , জীবনে কখনও যে মেয়ে সমাবেশ -মিছিল -মীটিং এ যাওয়ার কথা চিন্তাও করেনি , সেই শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে গিয়ে নির্দ্বিধায় স্লোগান দিয়েছে জয় বাংলা বলে । বাবার কোলে চড়ে শাহবাগে গিয়েছিল ছোট্ট শিশু । বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ শাহবাগে ধ্বনিত হয়েছিল শিশুর তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠে।

শাহবাগ -গনজাগরন মঞ্চ -প্রজন্ম চত্বর , যাই বলি না কেন , এখানে কিন্তু কেউ কোন ব্যাক্তিগত লাভের জন্য যায়নি । প্রজন্ম চত্বরে গিয়ে কেউ কিন্তু রাজনৈতিক নেতা -নেত্রী হয়ে যাচ্ছে না বা কোন আয় -উপার্জন , বাড়ি -গাড়ি পাচ্ছে না । প্রজন্ম চত্বরে কারা যায় ? এদের অধিকাংশই ব্যাক্তিগত জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন , অনেক সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য কে বিসর্জন দিয়েছেন এই শাহবাগের জন্য , গনজাগরন মঞ্চের এই আন্দোলনের জন্য । কেন , প্রেমিক শাহবাগের রাজাকার বিরোধী আন্দোলনের বিরোধী , রাজাকারের মুক্তি চায় জেনে যেই প্রেমিকা প্রেম ভেঙ্গে দিয়ে শাহবাগের মিছিলে ছুটে এসেছিল , সেই প্রেমিকার কি অধিকার ছিল না প্রেমিকের হাতে হাত রেখে সেই সময়টা কোন পার্কে ঘুরে বেড়ানোর ? যে মেয়েটি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে সাময়িক অথবা সম্পূর্ণ ভাবে , তার কি অধিকার ছিল না নিজের জীবনের দিকে তাকানোর ? যে বোনটি হুইলচেয়ারে করে শাহবাগে ছুটে এসেছে মধ্যরাতের মিছিলে , তার কি একটু বিশ্রাম করার অধিকার ছিল না ? যে মা শিশু সন্তান কে নিয়ে প্রজন্ম চত্বরে ছুটে এসেছেন রাজাকারের ফাসির দাবি জানাতে ? যে বাবা অফিস -আদালত সব বাদ দিয়ে দিনের পর দিন , রাতের পর রাত শাহবাগে বসে থেকেছেন , স্লোগান দিয়েছেন ? তরিকুল ইসলাম শান্ত -রাজীব হায়দার - আরিফ রায়হান দীপ - জগতজ্যোতি - জাফর মুন্সিরা জীবন দিয়েছেন এই আন্দোলনের জন্য - ব্যাক্তিগত কি লাভ ছিল তাদের ? কিংবা অনলাইনে সারাক্ষন জামাত -শিবিরের নানা রকম অপপ্রচারের জবাব দিচ্ছেন , তথ্য -উপাত্ত সংগ্রহ করছেন নিজেদের সব কাজ বাদ দিয়ে - ব্যাক্তিগত কি লাভ তাদের এখানে ? কোন কিছুই না - কিন্তু লাভ ছিল , লাভ আছে সমগ্র বাঙালি জাতির । বাঙালি জাতিস্বত্বার একজন মানুষ হিসেবে এই দেশটার প্রতি , দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি , দেশের মাটির প্রতি ঋণ রয়েছে এই শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের যোদ্ধাদের । আর তাই হৃদয়ের রক্তক্ষরন থেকে তারা ছুটে আসেন , ছুটে এসেছিলেন । এই প্রজন্ম যে জাহানারা ইমাম , প্রীতিলতা , সুফিয়া কামাল , ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী , রমা চৌধুরী , ত্রিশ লাখ শহীদ , দুই লাখ বীরাঙ্গনার প্রজন্ম। এই প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর প্রজন্ম । এরা হার মানতে জানেনা ।

শাহবাগ আন্দোলন কে নিয়ে পক্ষে - বিপক্ষে অনেক মতবাদ থাকবেই , এত বড় একটা জাগরন , এখানে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক । আর সবচেয়ে বড় কথা , আমরা যে যাই বলি না কেন -শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিটা যোদ্ধা নিজ অবস্থান থেকে , নিজের মত করে প্রত্যেকে এই বাংলাদেশ টাকে ভালোবাসে , আর ভালোবাসে বলেই তারা শাহবাগ আন্দোলনে ছুটে আসে । শাহবাগ আন্দোলন কোন নির্দিষ্ট দলের না , সারা বাংলাদেশের আন্দোলন । কাজেই বিভিন্ন মতামত থাকবেই এই আন্দোলন কারীদের মধ্যে , কারন এখানে অনেক দলের , অনেক মতের মানুষ রয়েছে আর সেটাই স্বাভাবিক , কিন্তু এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে আমাদের সবার মূল লক্ষ্য কি - "রাজাকারের ফাঁসি " । আর এই বিন্দুতে এসে সবাই এক ।  যত যাই বলুন না কেন - এ রামপাল বিরোধী আন্দোলন করে তো সে জয় বঙ্গবন্ধু বলে না তো আরেকজন ফেলানি হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করে - এগুলোর মানে কিন্তু এই না যে তারা রাজাকারের ফাসি চায়না কিংবা জামাত নিষিদ্ধ চায়না । ঐযে বললাম , দেশটা আমাদের সবার , আমরা সবাই দেশটাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম ভাবে ভাবতেই পারি -কিন্তু এক বিন্দুতে আমরা সবাই এক্তাবদ্ধ , আর তা হল রাজাকারের ফাসি । জয় বাংলা স্লোগান কিন্তু আগে সাধারন মানুষ দিত না ,কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের ফলে এখন ছোট বাচ্চাও জয় বাংলা বলে , চেতনার জন্মদান হয়ে গেছে - ওরা লালন করতে পারবে এখন । জয় বঙ্গবন্ধু ও বলবে , সবাই বলবে । তার আগে জয় বাংলা কে যেভাবে আওয়ামী গণ্ডি থেকে বের করে সারা বাংলার মানুষের স্লোগান হিসেবে শাহবাগ প্রতিষ্ঠিত করেছে , সেভাবে জয় বঙ্গবন্ধুকেও করতে হবে । এরপর শাহবাগ , সারা বাংলার সবাই জয় বাংলার পর জয় বঙ্গবন্ধু বলবে । আমার মনে হয় , এই স্লোগান নিয়ে আমরা নিজেরা তর্ক - বিতর্ক , শাহবাগে কেন বলা হয়না সেটা নিয়ে প্রশ্ন এসব বাদ দিয়ে প্রত্যেকে নিজেদের লেখায় , কথাবার্তায় জয় বাংলার সাথে জয় বঙ্গবন্ধু বলা শুরু করলে ভাল হয় । এতে আস্তে আস্তে সবাই অভ্যস্ত হবে , আমরাও শাহবাগ থেকে জয় বঙ্গবন্ধু বলতে পারব । শুধু শুধু তর্ক করে লাভ আছে নিজেদের মধ্যে ? এর চেয়ে কাজে সেটার প্রতিফলন ঘটালে ভাল হয় না ?

সবচেয়ে বড় কথা , যত তর্ক -বিতর্কই আমরা করি না কেন , মূল লক্ষ্য কিন্তু আমাদের সবার এক । আর তা হল রাজাকারের ফাসি । তাহলে এসব অর্থহীন তর্ক আর নিজেদের পক্ষের লোক দেরকেই বিভিন্ন রকম ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করি । আওয়ামি লীগ পন্থিরাও রাজাক্রের ফাসি চায় , বামপন্থীরাও রাজাকারের ফাসি চায় । চায়না শুধু বি এন পি -জামাত । পার্থক্য টা এখানেই থাক । আওয়ামি লিগ পন্থিরা যদি এখন বামদের বিরুদ্ধে কথা বলতে আর বাম রা আওয়ামি লীগ পন্থিদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ব্যাস্ত হয়ে পরেন তাইলে কিভাবে হবে ? মূল লক্ষ্য যখন এক , কাজেই শাহবাগের প্রশ্নে অন্তত আমরা সবাই এক থাকি । বিরোধ থাকুক , তর্ক হোক - কিন্তু অন্য আন্দোলনের জন্য শাহবাগ কে বিতর্কিত করে না । শাহবাগ সবার - মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার । রাজাকারের ফাসি চায় এমন প্রত্যেকটা মানুষের জন্য শাহবাগ - তা সে যে দল করুক বা যে দল সমর্থন করুক না কেন । এই ব্যাপারটা অন্তত মাথায় রেখে যাতে আমরা কাজ করি ।

আট মাস ধরে আন্দোলন তো হল । অবশেষে মনে হয় অনেক বড় একটা সুখবর পেতে যাচ্ছি আমরা । কসাই এর ফাসি নাকি ঈদের পর ই কার্যকর হবে । সেই আনন্দের দিনটাতে দল -মত নির্বিশেষে প্রত্যেকটা সহযোদ্ধার হাতে হাত রেখে বিজয় মিছিল করতে চাই । শাহবাগের আন্দোলনকারীদের একটাই পরিচয় তারা বাঙালি , তারা রাজাকারের ফাসি চায় । এর উপর আর কোন পরিচয়ের দরকার নেই । সব তর্ক - বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে শাহবাগের মাটি স্পর্শ করে বিজয় আনন্দে হাসতে চাই । ঈদের পর কাদের কসাই এর ফাসির আনন্দে বিজয় মিছিল করতে চাই সব সহযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে ।

জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় শহীদ জননী , জয় গনজাগরন মঞ্চ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন