২৯ আগস্ট , ২০১৩। ৪২ বছর আগে এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার রা ঢাকার অনেক গুলো গেরিলা হাইডআউটে আক্রমন চালায় , ধরে নিয়ে যায় রুমি - বদি - আজাদ - আলতাফ মাহমুদ - জুয়েল সহ ক্র্যাক প্লাটুনের আরও অনেক অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের । ধরা পরার আগ মুহূর্তে রুমি মা জাহানারা ইমাম এর কোলে শুয়ে ছিল , মা ছেলের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলেন - আর রেডিও তে বাজছিল "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি " । রুমি একটু অবাক হয়ে মা কে প্রশ্ন করে , এক ই দিনে এক ই গান তিন বার শুনলাম , ব্যপার টা কি !!! রুমি তখনও জানে না সেই দিনটি ছিল রুমির হাসি মুখে ফাসি পরার দিন। পাক হানাদাররা রুমির বাবা শরীফ ইমাম আর ভাই জামি কে ছেড়ে দেয় অনেক অত্যাচারের পর ।কিন্তু রুমি - বদি - আজাদ - আলতাফ মাহমুদ - জুয়েল দের ছাড়ে না। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরের কোন এক রাতে ঢাকার প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ।
হয়ত সে তালিকায় ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধারাও , শহীদ রুমি - বদি - আজাদ- আলতাফ মাহমুদ - জুয়েল রাও। পাকিস্তানি বাহিনির নির্যাতনের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ১৬ ই ডিসেম্বরে বিজয়ের কিছু আগে মারা যান রুমির বাবা শরিফ ইমাম । আর স্বাধীনতার পর ছেলের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে মাঠে নামেন মা জাহানারা ইমাম। আজকের উন্নত , আধুনিক ট্রাইব্যুনাল যা করতে পারে নি , মা জাহানারা ইমাম তা করে দেখিয়ে গেছেন অনেক আগেই। গন আদালতের সেই গন রায়ে রাজাকার প্রধান গোলাম আজমের জন্য রায়টা ছিল ফাঁসির । দেশ দ্রোহীর অপবাদ নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল শহীদ জননীকে - কিন্তু তার আগে প্রতিবাদের দীপ কিন্তু মা জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন । মা সাফিয়া বেগম বেঁচে ছিলেন স্বাধীনতার পর আরও ১৯ বছর। এই মা দীর্ঘ ১৯ বছর ভাত মুখে দেন নি এক বারের জন্য ও , কারন ছেলে আজাদ জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর কাছে একবার ভাত খেতে চেয়েছিল । এই মা আর কোনোদিন বিছানায় ঘুমান নি , কারন ছেলে আজাদ এম পি হোস্টেলের টর্চার সেলে ঘুমানোর জন্য বিছানা পায় নি ।
প্রিয় রুমী ভাইয়া,আজাদ ভাইয়া ,বদি ভাইয়া ,জুয়েল ভাইয়া,আলতাফ মাহমুদ ভাইয়া ,
তোমাদের কখনও সামনাসামনি দেখিনি , শুধু শুনেছি তোমাদের বীরত্বের কাহিনী আর চোখের জল ফেলেছি। মনের মধ্যে তোমাদের জন্য জমে আছে অনেক অনেক ভালোবাসা। ভাইয়া তোমাদের মত হতে পারব না কোনোদিন ই ,জানি। যতবার তোমাদের কথা পড়ি ,লিখি , শুনি- নিজের অজান্তেই কান্নায় চোখ ভিজে আসে । রুমী ভাইয়া তুমি তোমার নিশ্চিত জীবনের স্বপ্নকে নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছিলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে সফল করবার জন্য। ছোটবেলা থেকে মা শহীদজননী জাহানারা ইমাম তোমাকে শিখিয়েছিলেন , মাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করবে না। তুমি মাকে বলেছিলেন , "মা , আমেরিকা থেকে বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে হয়ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হব , কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না , তুমি কি তাই চাও আম্মা ?"তুখোড় বিতার্কিক ছিলে তুমি ভাইয়া ,তোমার অকাট্য যুক্তির কাছে হেরে যান মা , বলেন - "যা তোকে দেশের জন্য কুরবানি করে দিলাম , যা তুই যুদ্ধেই যা। " মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বদি , আজাদ সহ আরও অনেক সহযোদ্ধার সাথে যুদ্ধের ময়দানের খোঁজে বেরিয়ে পড়লে তুমি । ট্রেনিং নিলে, পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিলে বীরত্বের সাথে । শহীদ আজাদ ভাইয়া , তোমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে মায়ের সম্মান রক্ষার্থে মা কে সাথে নিয়ে বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেলে তুমি , ছোটবেলাতেই দেখালে সাহসিকতার পরিচয় , মায়ের সমমান রক্ষার্থে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে বাবার সম্পত্তিকে। এরপর জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হলে মা সাফিয়া বেগম ও তাঁর একমাত্র সন্তান আজাদ । অনেক চড়াই - উৎরাই পার হয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ের যখন দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছিলে , তখনই দেশে শুরু হয় স্বাধীনতার যু্দ্ধ। তুমি বন্ধুদের বললে , "আমি আমার মা কে বলব - মা,আমি যুদ্ধে যাব । মা যদি অনুমতি দেয় , তাহলে যাব । না হলে কি করব জানি না ।তোরা তো জানিস আমার মা বেঁচে আছে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।" মা সাফিয়া বেগম সন্তানকে হাসিমুখে অনুমতি দেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার । মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমাদের মগবাজারের বাড়িটি হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক বড় একটা আশ্রয়স্থল। এ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে , অস্ত্র রেখেছে । একই রকমভাবে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় পেয়েছে রুমী-বদি- জুয়েল-আলতাফ মাহমুদের বাসায়ও । অস্ত্রের এক একটি ভান্ডার হয়ে উঠেছিল তোমাদের মত টগবগে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িগুলো । ২৯ আগস্ট , ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তনীদের হাতে ধরা পড়লে তোমরা সবাই- রুমী , বদি , আজাদ , আলতাফ মাহমুদ , জুয়েল সহ আরও অনেক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা । দেশ মা এর ডাকে অকুতোভয় শহীদ রুমী ভাইয়া -তুমি তোমার বাবাকে , ভাইকে শিখিয়ে দিলে যাতে তারা বলেন ছেলে কোথায় কি করে তাঁরা জানেন না । ভাইয়া তোমার বাবা শরীফ ইমাম , ছোটো ভাই জামী কে অনেক অত্যাচারের পর ছেড়ে দেয় পাক বাহিনী। এই অত্যাচারের সুদরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযু্দ্ধ চলাকালীন সময়ে মারা যান বাবা শরীফ ইমাম । রুমী - বদি- আজাদ-আলতাফ মাহমুদ-জুয়েল , এক একটি নক্ষত্রের নাম -তোমরা কেউ মুক্তি পেলে না । আজাদ ভাইয়া, তোমার মা সাফিয়া বেগম একবার সুযোগ পান তোমার সাথে দেখা করার । বলেন শক্ত হয়ে থাকতে , কারও নাম না বলতে। তুমি মা এর কাছে ভাত খেতে চাইলে - মা পরদিন ভাত নিয়ে গিয়ে তোমাকে আর খুঁজে পান না । জীবনে কোনোদিন মা আর ভাত খান নি , কোনোদিন বিছানায় ঘুমাননি ।বীর মুক্তিযোদ্ধা বদি ভাইয়া , পাকিস্তানীদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ইলেক্ট্রিক প্লাগের ছিদ্রের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছিলে শক খেয়ে মরার আশায়।পাকিস্তানিরা দেখতে পেয়ে বাধা দিতে আসলে দৌঁড় দিলে পাকিস্তানিরা গুলি করবে সে আশায় ।নাহ , অতটা উদারতা পাকিস্তানিরা দেখায় না। বরং ধরে এনে বেয়নেট চার্জ করে তোমার উপর। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি" গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ ভাইয়া , বেয়নেট চার্জ করা হলে তোমার কপালের পাশে চামড়া কেটে যায় ,সে অবস্থায় তোমাকেধরে নিয়ে যায় পাক হায়েনারা।ক্যাম্পে নিয়ে চালায় অকথ্য নির্যাতন , তোমার সুর করা গান যে পাকিস্তানিদের আঘাত করার জন্য বুলেটের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি শক্তিশালী । আহত মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল ভাইয়া, তোমার ক্ষতস্থান চেপে ধরে পাকিস্তানি মেজর , যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তুমি চিৎকার করে ওঠ যন্ত্রণা সইতে না পেরে। পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে একে একে মেরে ফেলে রুমী-বদি-আজাদ-আলতাফ মাহমুদ-জুয়েল -প্রতিটা নক্ষত্রকে ।আর এসবের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে পাকিস্তানিদের অসংখ্য টর্চার সেল , রুমী - আজাদদের বাড়ি , যুদ্ধদিনের অসংখ্য স্মৃতিকথাগুলি।
মা জাহানারা ইমাম মৃত্যুর আগে শেষ চিঠি রেখে গেছেন আমাদের জন্য । মা বলেছেন - "আমার সহযোদ্ধা বন্ধুগণ, আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এ লড়াই আপনাদের, দেশবাসীর অভূতপূর্ব একতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সা...র আমাকে মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারোর নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা অবশ্যই আপনাদের কথা রাখবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আমি জানবো, আমার কোটি কোটি বাঙালি সন্তানেরা আপনাদের পুত্র-কন্যাদের নিয়ে মুক্ত সোনার বাংলায় বসবাস করছেন। এই আন্দোলন এখনো দূরপথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মুক্তিযোদ্ধা-নারী-ছাত্র-যুবশক্তি-নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি, জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। নিশ্চিত জয় আমাদের হবেই।"
মা জাহানারা ইমামের সেই স্বপ্ন সফল করার দায়িত্ব আজ আমাদের । মনে রাখতে হবে , এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই , এ লড়াই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির লড়াই , এ লড়াই যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলা গড়ার লড়াই , এ লড়াই মা এর কাছে সন্তানের ওয়াদা রক্ষার লড়াই ।
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় তারুন্য , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।
হয়ত সে তালিকায় ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধারাও , শহীদ রুমি - বদি - আজাদ- আলতাফ মাহমুদ - জুয়েল রাও। পাকিস্তানি বাহিনির নির্যাতনের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ১৬ ই ডিসেম্বরে বিজয়ের কিছু আগে মারা যান রুমির বাবা শরিফ ইমাম । আর স্বাধীনতার পর ছেলের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে মাঠে নামেন মা জাহানারা ইমাম। আজকের উন্নত , আধুনিক ট্রাইব্যুনাল যা করতে পারে নি , মা জাহানারা ইমাম তা করে দেখিয়ে গেছেন অনেক আগেই। গন আদালতের সেই গন রায়ে রাজাকার প্রধান গোলাম আজমের জন্য রায়টা ছিল ফাঁসির । দেশ দ্রোহীর অপবাদ নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল শহীদ জননীকে - কিন্তু তার আগে প্রতিবাদের দীপ কিন্তু মা জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন । মা সাফিয়া বেগম বেঁচে ছিলেন স্বাধীনতার পর আরও ১৯ বছর। এই মা দীর্ঘ ১৯ বছর ভাত মুখে দেন নি এক বারের জন্য ও , কারন ছেলে আজাদ জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর কাছে একবার ভাত খেতে চেয়েছিল । এই মা আর কোনোদিন বিছানায় ঘুমান নি , কারন ছেলে আজাদ এম পি হোস্টেলের টর্চার সেলে ঘুমানোর জন্য বিছানা পায় নি ।
প্রিয় রুমী ভাইয়া,আজাদ ভাইয়া ,বদি ভাইয়া ,জুয়েল ভাইয়া,আলতাফ মাহমুদ ভাইয়া ,
তোমাদের কখনও সামনাসামনি দেখিনি , শুধু শুনেছি তোমাদের বীরত্বের কাহিনী আর চোখের জল ফেলেছি। মনের মধ্যে তোমাদের জন্য জমে আছে অনেক অনেক ভালোবাসা। ভাইয়া তোমাদের মত হতে পারব না কোনোদিন ই ,জানি। যতবার তোমাদের কথা পড়ি ,লিখি , শুনি- নিজের অজান্তেই কান্নায় চোখ ভিজে আসে । রুমী ভাইয়া তুমি তোমার নিশ্চিত জীবনের স্বপ্নকে নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছিলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে সফল করবার জন্য। ছোটবেলা থেকে মা শহীদজননী জাহানারা ইমাম তোমাকে শিখিয়েছিলেন , মাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করবে না। তুমি মাকে বলেছিলেন , "মা , আমেরিকা থেকে বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে হয়ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হব , কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না , তুমি কি তাই চাও আম্মা ?"তুখোড় বিতার্কিক ছিলে তুমি ভাইয়া ,তোমার অকাট্য যুক্তির কাছে হেরে যান মা , বলেন - "যা তোকে দেশের জন্য কুরবানি করে দিলাম , যা তুই যুদ্ধেই যা। " মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বদি , আজাদ সহ আরও অনেক সহযোদ্ধার সাথে যুদ্ধের ময়দানের খোঁজে বেরিয়ে পড়লে তুমি । ট্রেনিং নিলে, পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিলে বীরত্বের সাথে । শহীদ আজাদ ভাইয়া , তোমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে মায়ের সম্মান রক্ষার্থে মা কে সাথে নিয়ে বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেলে তুমি , ছোটবেলাতেই দেখালে সাহসিকতার পরিচয় , মায়ের সমমান রক্ষার্থে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে বাবার সম্পত্তিকে। এরপর জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হলে মা সাফিয়া বেগম ও তাঁর একমাত্র সন্তান আজাদ । অনেক চড়াই - উৎরাই পার হয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ের যখন দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছিলে , তখনই দেশে শুরু হয় স্বাধীনতার যু্দ্ধ। তুমি বন্ধুদের বললে , "আমি আমার মা কে বলব - মা,আমি যুদ্ধে যাব । মা যদি অনুমতি দেয় , তাহলে যাব । না হলে কি করব জানি না ।তোরা তো জানিস আমার মা বেঁচে আছে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।" মা সাফিয়া বেগম সন্তানকে হাসিমুখে অনুমতি দেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার । মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমাদের মগবাজারের বাড়িটি হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক বড় একটা আশ্রয়স্থল। এ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে , অস্ত্র রেখেছে । একই রকমভাবে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় পেয়েছে রুমী-বদি- জুয়েল-আলতাফ মাহমুদের বাসায়ও । অস্ত্রের এক একটি ভান্ডার হয়ে উঠেছিল তোমাদের মত টগবগে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িগুলো । ২৯ আগস্ট , ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তনীদের হাতে ধরা পড়লে তোমরা সবাই- রুমী , বদি , আজাদ , আলতাফ মাহমুদ , জুয়েল সহ আরও অনেক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা । দেশ মা এর ডাকে অকুতোভয় শহীদ রুমী ভাইয়া -তুমি তোমার বাবাকে , ভাইকে শিখিয়ে দিলে যাতে তারা বলেন ছেলে কোথায় কি করে তাঁরা জানেন না । ভাইয়া তোমার বাবা শরীফ ইমাম , ছোটো ভাই জামী কে অনেক অত্যাচারের পর ছেড়ে দেয় পাক বাহিনী। এই অত্যাচারের সুদরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযু্দ্ধ চলাকালীন সময়ে মারা যান বাবা শরীফ ইমাম । রুমী - বদি- আজাদ-আলতাফ মাহমুদ-জুয়েল , এক একটি নক্ষত্রের নাম -তোমরা কেউ মুক্তি পেলে না । আজাদ ভাইয়া, তোমার মা সাফিয়া বেগম একবার সুযোগ পান তোমার সাথে দেখা করার । বলেন শক্ত হয়ে থাকতে , কারও নাম না বলতে। তুমি মা এর কাছে ভাত খেতে চাইলে - মা পরদিন ভাত নিয়ে গিয়ে তোমাকে আর খুঁজে পান না । জীবনে কোনোদিন মা আর ভাত খান নি , কোনোদিন বিছানায় ঘুমাননি ।বীর মুক্তিযোদ্ধা বদি ভাইয়া , পাকিস্তানীদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ইলেক্ট্রিক প্লাগের ছিদ্রের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছিলে শক খেয়ে মরার আশায়।পাকিস্তানিরা দেখতে পেয়ে বাধা দিতে আসলে দৌঁড় দিলে পাকিস্তানিরা গুলি করবে সে আশায় ।নাহ , অতটা উদারতা পাকিস্তানিরা দেখায় না। বরং ধরে এনে বেয়নেট চার্জ করে তোমার উপর। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি" গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ ভাইয়া , বেয়নেট চার্জ করা হলে তোমার কপালের পাশে চামড়া কেটে যায় ,সে অবস্থায় তোমাকেধরে নিয়ে যায় পাক হায়েনারা।ক্যাম্পে নিয়ে চালায় অকথ্য নির্যাতন , তোমার সুর করা গান যে পাকিস্তানিদের আঘাত করার জন্য বুলেটের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি শক্তিশালী । আহত মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল ভাইয়া, তোমার ক্ষতস্থান চেপে ধরে পাকিস্তানি মেজর , যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তুমি চিৎকার করে ওঠ যন্ত্রণা সইতে না পেরে। পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে একে একে মেরে ফেলে রুমী-বদি-আজাদ-আলতাফ মাহমুদ-জুয়েল -প্রতিটা নক্ষত্রকে ।আর এসবের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে পাকিস্তানিদের অসংখ্য টর্চার সেল , রুমী - আজাদদের বাড়ি , যুদ্ধদিনের অসংখ্য স্মৃতিকথাগুলি।
মা জাহানারা ইমাম মৃত্যুর আগে শেষ চিঠি রেখে গেছেন আমাদের জন্য । মা বলেছেন - "আমার সহযোদ্ধা বন্ধুগণ, আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এ লড়াই আপনাদের, দেশবাসীর অভূতপূর্ব একতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সা...র আমাকে মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারোর নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা অবশ্যই আপনাদের কথা রাখবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আমি জানবো, আমার কোটি কোটি বাঙালি সন্তানেরা আপনাদের পুত্র-কন্যাদের নিয়ে মুক্ত সোনার বাংলায় বসবাস করছেন। এই আন্দোলন এখনো দূরপথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মুক্তিযোদ্ধা-নারী-ছাত্র-যুবশক্তি-নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি, জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। নিশ্চিত জয় আমাদের হবেই।"
মা জাহানারা ইমামের সেই স্বপ্ন সফল করার দায়িত্ব আজ আমাদের । মনে রাখতে হবে , এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই , এ লড়াই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির লড়াই , এ লড়াই যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলা গড়ার লড়াই , এ লড়াই মা এর কাছে সন্তানের ওয়াদা রক্ষার লড়াই ।
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় তারুন্য , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন