নীলা আজকে লাল -সবুজ শাড়িটা পরেছে , শাহেদের সাথে দেখা করার কথা একটু পরে। হাতে মেহেদি দিয়েছে অনেক যত্ন করে । এই শাড়িটা নীলার সবচেয়ে প্রিয় , শাহেদ ও যেন এই রঙ টা একটু বেশি ই ভালোবাসে । একবার এ নিয়ে প্রশ্ন করায় শাহেদ উত্তর দিয়েছিল, লাল -সবুজ ভালবাসবো না কেন নীলা ? লাল -সবুজ যে আমাদের পতাকার রঙ , আমাদের চেতনার রঙ , আমাদের বাংলাদেশের রঙ। নীলাও বোঝে আর এক ই কারণে তারও প্রিয় রঙ এটাই । আজ মার্চ মাসের সাত তারিখ । শাহেদের সাথে দেখা করে এরপর দুইজন মিলে প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে , এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মীটিং এ যাওয়ার কথা। অনেক সাধারন ছাত্র- ছাত্রী হলেও সময়ের প্রয়োজনে এখন ওরা নিজেরাই যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন গুলোর সাথে । মীটিং এ যায় , সবার আলোচনা শোনে , নিজেদের মতামত থাকলে প্রকাশ করে – এখন ১৯৭১ সাল। সামনে দেশ টার অনেক বড় বিপদ। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে জিতলেও ইয়াহিয়া -ভুট্টো তাকে ক্ষমতায় বসতে দেবে না নিশ্চিত। মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী পরিনতি এখন , আর সেই মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে এই ছাত্রদেরই – এই নীলা -শাহেদ , রহিম , সাজেদা , কাসেম দের ই। আর তাই তারা কেউ চুপ করে বসে নেই। অনেক গোপনে এক একটা মীটিং করছে তারা , আর প্রতিদিনের ঘটনা তাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে – তোমরা ঠিক পথেই যাচ্ছ । বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে চূড়ান্ত মুক্তি এবার অর্জন করে নিতেই হবে তোমাদেরকে ।
নীলা আর শাহেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছায়। এখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ওরা । আজকে ওদের কারোর ই নিজেদের নিয়ে আলাপ করার মত মানসিকতা নেই , নেই প্রেম – ভালোবাসার আলাপ করার মত মনের অবস্থা। নীলা শাহেদের হাত ধরে রেখেছে , কিন্তু সেই হাত ধরায় যতটা আছে প্রেম , তার চেয়ে অনেক বেশি আছে দৃঢ় প্রত্যয়। বঙ্গবন্ধু আজ ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন – “তোমাদের যা কিছু আছে , তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা , রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব । এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম , আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম , স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ” সেই ঘোষণা কানে বাজছে আজকে মীটিং এ আসা প্রত্যেকটি ছাত্র -ছাত্রীর । মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে এবার আমাদেরকে – জয় বাংলা বলে লড়াই এ ঝাপিয়ে পরতে হবে। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে । সবাই প্রস্তুত ? – জিজ্ঞেস করে শাহেদ। নীলা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে প্রেমিকের দিকে। প্রেমিক শাহেদের এই রণমূর্তি সে আগে কখনও দেখে নি। অবাক বিস্ময়ে নীলা লক্ষ্য করে , এক ই আগুন যে তার নিজের অন্তরেও। চিৎকার করে শপথ বাক্য পাঠ করাচ্ছে সে সমবেত প্রত্যেকটা ছাত্র -ছাত্রীকে। সে শপথ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলা মা কে মুক্ত করার শপথ , প্রয়োজন হলে নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও বাংলাদেশ কে মুক্ত করার শপথ। সে শপথ জয় বাংলার জন্য নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়ে যাওয়ার শপথ।
২৫ মার্চ , ১৯৭১। পাকিস্তানি মিলিটারি সারা দেশ জুড়ে চালাচ্ছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ । নিরস্ত্র , নিরীহ বাঙ্গালির বুক তারা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে বুলেট -মেশিনগান – ট্যাংকে। নীলাদের বাড়ি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছেই। সেখানে বাঙালি পুলিশেরা গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ , প্রতিরোধ – বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে নীলা । যে করেই হোক ওকে এখন শাহেদের কাছে যেতেই হবে। নীলার বাবা গ্রামের বাড়িতে গেলেই এলাকার মানুষ কে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে বলে , কাজেই এই বাড়িতে ওরা মীটিং করতে পারবেনা। এ কারনেই বেছে নেয়া হয়েছে শাহেদের বাড়িটা। শাহেদের বাবা দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় চাকরি করেন , বাংলাদেশের মুক্তি চান । ছেলেমেয়েদের কে নিজের বাড়িতে মীটিং করতে দিতে তিনি সানন্দে রাজি হয়েছেন । পাশাপাশি বলে দিয়েছেন যেন যে কোন প্রয়োজনে তাকে জানানো হয় , ছেলেমেয়েদের যে কোন রকম সাহায্য করতে তিনি রাজি আছেন । রাস্তায় অনবরত গোলাগুলি , জায়গায় জায়গায় বাঙালি পুলিশের মৃতদেহ – অনেক কষ্টে শাহেদের বাসায় এসে পৌছায় নীলা। সেখানে বাকি সবাই ততক্ষনে এসে উপস্থিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয় , আজ ই সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সবাই ,ভারতে গিয়ে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নেবে , এরপর দেশের সীমানায় প্রবেশ করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবে। রাত আর একটু গভীর হলেই বেরিয়ে পরবে ওরা ।
“কে ট্রেনিং দেবে আমাদের ?” -নীলা প্রশ্ন করে। “ই পি আর এর অনেক সৈনিক আমাদের সাথে যাচ্ছেন সাধারন কৃষক -মজুরের বেশে , ” -শাহেদ উত্তর দেয়। “তাঁরাই আমাদেরকে ট্রেনিং দেবেন।” হটাত নীলা বলে ওঠে , “একটা কথা শোনো , আমার বাবার মত কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের পাশে দাঁড়াবে না , আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করবে। তাদের থেকেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে।” শাহেদ হেসে ওঠে , বলে – ” অত সাবধান থাকতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ হবে না। এটা একটা ডু অর ডাই মিশন। এই লড়াই এ আমাদের জিততেই হবে। আর রাজাকারের কথা বলছ ? প্রত্যেকটা জাতির মুক্তিসংগ্রামেই এই রাজাকার থাকে , এরা বাঙালি হয়েও আমাদের বিরোধিতা করবে। এরা নিজের দেশের সাথেই বিরোধিতা করবে। পাকিস্তানি মিলিটারি এবং রাজাকার এরা সবাই আমাদের প্রতিপক্ষ , এদের সাথে আমাদের লড়াই করতে হবে , লড়াই করে দেশ মা কে মুক্ত করতে হবে। জয় বাংলা ।” শাহেদ কথা শেষ করার সাথে সাথে সবাই চিৎকার করে ওঠে জয় বাংলা বলে। এরপর নিশিথ রাতে একদল তরুন -তরুণী বেড়িয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রের খোঁজে। পেছনে পরে থাকে তাদের শৈশব , কৈশোর , হাজারো স্মৃতি। এখন তারা শুধুই মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমি কে স্বাধীন করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য।
আজ মে মাসের ১৮ তারিখ। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে দল টি। ওদের প্রথম টার্গেট কুমিল্লার পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমন করা। কয়েকদিন রেকি করে আসে ওরা ক্যাম্প টার কাছে থেকে । এরপর একদিন চূড়ান্ত আক্রমন। ক্যাম্পের কে কোথায় থাকে , কখন সজাগ থাকে , কখন অমনোযোগী থাকে সব মুখস্ত হয়ে গেছে এখন ওদের । দুপুরে খাওয়ার পর পাক হানাদার বাহিনী যখন নেশায় মত্ত , তখন অতর্কিত আক্রমন করে মুক্তিবাহিনী । ক্যাম্পে থাকা অধিকাংশ পাকিস্তানিকে খতম করতে খুব বেশি সময় লাগে না , পাহারায় থাকা সবাইকে শেষ করে মুক্তিবাহিনী ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ক্যাম্পের ভিতরে থাকা মিলিটারিরাও তখন ঘুমে , না হয় নেশায় আচ্ছন্ন। খুব সহজেই ওদের কে পরাজিত করতে সক্ষম হয় নীলা – শাহেদ – কামাল – রশিদ-সাজেদা রা। সেই ক্যাম্পের পিছনে একটা ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় হাত -পা বাঁধা অবস্থায় একজন মা কে। পাকিস্তানি বাহিনী অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালিয়েছে এই মা এর উপর দিয়ে। পেটের সন্তান মারা গেছে কবেই , মা এর অবস্থাও খারাপ। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ওরা সেই মাকে। এদিকে পাকিস্তানি মিলিটারি খবর পেয়ে চলে আসে সেই হাসপাতালে। নীলা তখন মা কে একটু কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। মিলিটারি হাসপাতালে ঢুকে সবার আগে নীলার কাছে আসে। এক ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দিয়ে ওর উপর গুলি চালায় ওরা । অট্টহাসি তে ফেটে পরে এলাকার রাজাকার কম্যান্ডার আর মিলিটারি অফিসার। নীলাকে জিজ্ঞেস করে দলের বাকি সবাই কোথায়। শিউরে ওঠে নীলা , সবাইকে পাক হানাদারের হাতে তুলে দিতে চায়না সে , নীলা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে না। দলের বাকি সবাই তখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাইরে গিয়েছিল , কিন্তু সে কথা নিজের জীবন থাকতে উচ্চারন করবে না নীলা । একের পর এক বেয়নেটের আঘাত সহ্য করতে থাকে নীলা । জীবন থাকতে সে সহযোদ্ধাদের খোঁজ পাক বাহিনীকে দেবে না ।
একদিন -এক রাতের জন্য আশ্রয় জোগাড় করা গেছে , শাহেদ আর অন্যরা হাসপাতালে ফিরে আসছে নীলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হাসপাতালের কাছাকাছি আসতেই তারা শুনতে পায় ভিতরে পাক বাহিনীর উল্লাস আর নীলার আর্তনাদ। দ্রুত পজিশন নিয়ে নেয় মুক্তিবাহিনী। আক্রমন চালায় পাক হানাদার দের উপর। অতর্কিত আক্রমনে আবার মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজিত হয় পাক বাহিনী। অধিকাংশ মিলিটারি মারা যায় , কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মিলিটারিদের পরাজিত করে এক ছুটে সবাই চলে আসে নীলার কাছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন নীলা । শাহেদ গিয়ে নীলার হাত ধরে। কিন্তু নীলার চোখে তখন নেই মৃত্যুযন্ত্রণা – তাঁর চোখেমুখে তখন বিজয় আনন্দ , পাক হানাদারদের পরাজিত করতে পেরেছে ওরা । লাল -সবুজ শাড়ি রক্তে লাল হয়ে গেছে তখন। পরম পরিতৃপ্তির একটা হাসি মুখে নিয়ে শাহেদের দিকে তাকায় নীলা। দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে নীলার চোখ থেকে , জীবনের শেষ কান্না -শেষ দু ফোটা ভালবাসার অশ্রু , প্রিয় বাংলাদেশ টার জন্য ভালোবাসা , সহযোদ্ধাদের জন্য ভালোবাসা , মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভালোবাসা ।
আজ বিয়াল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে । অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর দেশ টা স্বাধীন হয়েছে , বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে পাক হানাদার দের কবল থেকে। কিন্তু ঐযে নীলা একদিন বলেছিল – রাজাকার দের থেকে সাবধান থাকার কথা -সেই রাজাকার রা রয়ে গেল বাংলাদেশেই। একদিন তারা সপরিবারে হত্যা করল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে। বাংলাদেশ আবার অগ্রসর হল অন্ধকারের দিকে। সে অন্ধকারের যুগে রাষ্ট্রক্ষমতায় এল একাত্তরের ঘাতক -দালাল রা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের উপর চালাতে লাগলো অত্যাচার , ইতিহাস কে বিকৃত করল , মুক্তিযুদ্ধ কে সরিয়ে দিল নাটক -সিনেমা থেকে। একে একে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মূলনীতির বিরোধিতা করল তারা। প্রতিবাদ করে উঠলেন একজন মা – রাজাকারের ফাসি চাইলেন , গনআদালত গড়লেন , রাজাকার সর্দার গোলাম আজমের জন্য ফাসির রায় এল গনআদালতের গণরায় থেকে । রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনল মা জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। মা লড়াই চালিয়ে গেলেন , মৃত্যুর আগে রেখে গেলেন শেষ চিঠি – “এ আন্দোলন কে সুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। আমি জানি জনগনের চেয়ে বিশ্বস্ত কেউ নেই। জয় আমাদের হবেই ।”
সেই অমর চিঠিকে বুকে নিয়ে বিয়াল্লিশ বছর পর জেগে উঠলো এক দল তরুণ । শাহবাগে আবার সমবেত হল তারা , মা জাহানারা ইমামের স্বপ্নকে সফল করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল । শাহেদ – কামাল -রশিদেরা এক বুক কষ্ট নিয়ে ততদিনে চলে গেছেন জীবন নদীর অপর পাড়ে । বেঁচে আছেন এই দলের আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাজেদা। ১৯৭১ সালে তাঁদের করা মীটিং – মিছিল -স্লোগান সব কিছু আবার ফিরে আসতে দেখেন তিনি ২০১৩ তে। শাহবাগে সমবেত জনতার মধ্যে তিনি দেখতে পান সেদিনের নীলা -শাহেদ কে , হাতে হাত রেখে তারা হাঁটছে কিন্তু প্রেমের গল্প করতে করতে নয় , স্বাধীন বাংলায় রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে একাত্ম হয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছে মিছিলে আজকের নীলা – শাহেদরা। শহীদ দীপ যে শপথ নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন , শহীদ নীলার ও তো সেই এক ই শপথ ছিল , শহীদ রুমি -বদি -আজাদ -আলতাফ মাহমুদের ও তো সেই এক ই শপথ ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদা বেগমের চোখে একাকার হয়ে যায় ১৯৭১ আর ২০১৩। ঝাপসা চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন অগ্রসরমান মিছিলের দিকে , চোখ থেকে গড়িয়ে পরে দুই ফোটা আনন্দাশ্রু – এই প্রজন্ম আবার জাগতে পেরেছে , বাংলার মাটিতে রাজাকারদের পরাজয় ঘণ্টা বেজে গেছে , এই বাঙ্গালিকে আর কেউ দমাতে পারবে না। সালমা এসব ভেবে আনন্দে কাঁদতে থাকেন , আর সমবেত জনতার সমাবেশ থেকে স্লোগান ওঠে – “লক্ষ শহীদ ডাক দিয়েছে , সব সাথীদের খবর দে – সারা বাংলা ঘেরাও করে , রাজাকারের কবর দে। ” দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলে শাহবাগের মিছিল , অনেক দূর পথচলা যে এখনও বাকি।
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু। জয় প্রজন্ম , জয় শহীদজননী , জয় প্রজন্ম চত্বর । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।
নীলা আর শাহেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছায়। এখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ওরা । আজকে ওদের কারোর ই নিজেদের নিয়ে আলাপ করার মত মানসিকতা নেই , নেই প্রেম – ভালোবাসার আলাপ করার মত মনের অবস্থা। নীলা শাহেদের হাত ধরে রেখেছে , কিন্তু সেই হাত ধরায় যতটা আছে প্রেম , তার চেয়ে অনেক বেশি আছে দৃঢ় প্রত্যয়। বঙ্গবন্ধু আজ ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন – “তোমাদের যা কিছু আছে , তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা , রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব । এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম , আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম , স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ” সেই ঘোষণা কানে বাজছে আজকে মীটিং এ আসা প্রত্যেকটি ছাত্র -ছাত্রীর । মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে এবার আমাদেরকে – জয় বাংলা বলে লড়াই এ ঝাপিয়ে পরতে হবে। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে । সবাই প্রস্তুত ? – জিজ্ঞেস করে শাহেদ। নীলা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে প্রেমিকের দিকে। প্রেমিক শাহেদের এই রণমূর্তি সে আগে কখনও দেখে নি। অবাক বিস্ময়ে নীলা লক্ষ্য করে , এক ই আগুন যে তার নিজের অন্তরেও। চিৎকার করে শপথ বাক্য পাঠ করাচ্ছে সে সমবেত প্রত্যেকটা ছাত্র -ছাত্রীকে। সে শপথ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলা মা কে মুক্ত করার শপথ , প্রয়োজন হলে নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও বাংলাদেশ কে মুক্ত করার শপথ। সে শপথ জয় বাংলার জন্য নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়ে যাওয়ার শপথ।
২৫ মার্চ , ১৯৭১। পাকিস্তানি মিলিটারি সারা দেশ জুড়ে চালাচ্ছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ । নিরস্ত্র , নিরীহ বাঙ্গালির বুক তারা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে বুলেট -মেশিনগান – ট্যাংকে। নীলাদের বাড়ি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছেই। সেখানে বাঙালি পুলিশেরা গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ , প্রতিরোধ – বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে নীলা । যে করেই হোক ওকে এখন শাহেদের কাছে যেতেই হবে। নীলার বাবা গ্রামের বাড়িতে গেলেই এলাকার মানুষ কে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে বলে , কাজেই এই বাড়িতে ওরা মীটিং করতে পারবেনা। এ কারনেই বেছে নেয়া হয়েছে শাহেদের বাড়িটা। শাহেদের বাবা দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় চাকরি করেন , বাংলাদেশের মুক্তি চান । ছেলেমেয়েদের কে নিজের বাড়িতে মীটিং করতে দিতে তিনি সানন্দে রাজি হয়েছেন । পাশাপাশি বলে দিয়েছেন যেন যে কোন প্রয়োজনে তাকে জানানো হয় , ছেলেমেয়েদের যে কোন রকম সাহায্য করতে তিনি রাজি আছেন । রাস্তায় অনবরত গোলাগুলি , জায়গায় জায়গায় বাঙালি পুলিশের মৃতদেহ – অনেক কষ্টে শাহেদের বাসায় এসে পৌছায় নীলা। সেখানে বাকি সবাই ততক্ষনে এসে উপস্থিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয় , আজ ই সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সবাই ,ভারতে গিয়ে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নেবে , এরপর দেশের সীমানায় প্রবেশ করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবে। রাত আর একটু গভীর হলেই বেরিয়ে পরবে ওরা ।
“কে ট্রেনিং দেবে আমাদের ?” -নীলা প্রশ্ন করে। “ই পি আর এর অনেক সৈনিক আমাদের সাথে যাচ্ছেন সাধারন কৃষক -মজুরের বেশে , ” -শাহেদ উত্তর দেয়। “তাঁরাই আমাদেরকে ট্রেনিং দেবেন।” হটাত নীলা বলে ওঠে , “একটা কথা শোনো , আমার বাবার মত কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের পাশে দাঁড়াবে না , আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করবে। তাদের থেকেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে।” শাহেদ হেসে ওঠে , বলে – ” অত সাবধান থাকতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ হবে না। এটা একটা ডু অর ডাই মিশন। এই লড়াই এ আমাদের জিততেই হবে। আর রাজাকারের কথা বলছ ? প্রত্যেকটা জাতির মুক্তিসংগ্রামেই এই রাজাকার থাকে , এরা বাঙালি হয়েও আমাদের বিরোধিতা করবে। এরা নিজের দেশের সাথেই বিরোধিতা করবে। পাকিস্তানি মিলিটারি এবং রাজাকার এরা সবাই আমাদের প্রতিপক্ষ , এদের সাথে আমাদের লড়াই করতে হবে , লড়াই করে দেশ মা কে মুক্ত করতে হবে। জয় বাংলা ।” শাহেদ কথা শেষ করার সাথে সাথে সবাই চিৎকার করে ওঠে জয় বাংলা বলে। এরপর নিশিথ রাতে একদল তরুন -তরুণী বেড়িয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রের খোঁজে। পেছনে পরে থাকে তাদের শৈশব , কৈশোর , হাজারো স্মৃতি। এখন তারা শুধুই মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমি কে স্বাধীন করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য।
আজ মে মাসের ১৮ তারিখ। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে দল টি। ওদের প্রথম টার্গেট কুমিল্লার পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমন করা। কয়েকদিন রেকি করে আসে ওরা ক্যাম্প টার কাছে থেকে । এরপর একদিন চূড়ান্ত আক্রমন। ক্যাম্পের কে কোথায় থাকে , কখন সজাগ থাকে , কখন অমনোযোগী থাকে সব মুখস্ত হয়ে গেছে এখন ওদের । দুপুরে খাওয়ার পর পাক হানাদার বাহিনী যখন নেশায় মত্ত , তখন অতর্কিত আক্রমন করে মুক্তিবাহিনী । ক্যাম্পে থাকা অধিকাংশ পাকিস্তানিকে খতম করতে খুব বেশি সময় লাগে না , পাহারায় থাকা সবাইকে শেষ করে মুক্তিবাহিনী ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ক্যাম্পের ভিতরে থাকা মিলিটারিরাও তখন ঘুমে , না হয় নেশায় আচ্ছন্ন। খুব সহজেই ওদের কে পরাজিত করতে সক্ষম হয় নীলা – শাহেদ – কামাল – রশিদ-সাজেদা রা। সেই ক্যাম্পের পিছনে একটা ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় হাত -পা বাঁধা অবস্থায় একজন মা কে। পাকিস্তানি বাহিনী অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালিয়েছে এই মা এর উপর দিয়ে। পেটের সন্তান মারা গেছে কবেই , মা এর অবস্থাও খারাপ। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ওরা সেই মাকে। এদিকে পাকিস্তানি মিলিটারি খবর পেয়ে চলে আসে সেই হাসপাতালে। নীলা তখন মা কে একটু কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। মিলিটারি হাসপাতালে ঢুকে সবার আগে নীলার কাছে আসে। এক ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দিয়ে ওর উপর গুলি চালায় ওরা । অট্টহাসি তে ফেটে পরে এলাকার রাজাকার কম্যান্ডার আর মিলিটারি অফিসার। নীলাকে জিজ্ঞেস করে দলের বাকি সবাই কোথায়। শিউরে ওঠে নীলা , সবাইকে পাক হানাদারের হাতে তুলে দিতে চায়না সে , নীলা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে না। দলের বাকি সবাই তখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাইরে গিয়েছিল , কিন্তু সে কথা নিজের জীবন থাকতে উচ্চারন করবে না নীলা । একের পর এক বেয়নেটের আঘাত সহ্য করতে থাকে নীলা । জীবন থাকতে সে সহযোদ্ধাদের খোঁজ পাক বাহিনীকে দেবে না ।
একদিন -এক রাতের জন্য আশ্রয় জোগাড় করা গেছে , শাহেদ আর অন্যরা হাসপাতালে ফিরে আসছে নীলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হাসপাতালের কাছাকাছি আসতেই তারা শুনতে পায় ভিতরে পাক বাহিনীর উল্লাস আর নীলার আর্তনাদ। দ্রুত পজিশন নিয়ে নেয় মুক্তিবাহিনী। আক্রমন চালায় পাক হানাদার দের উপর। অতর্কিত আক্রমনে আবার মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজিত হয় পাক বাহিনী। অধিকাংশ মিলিটারি মারা যায় , কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মিলিটারিদের পরাজিত করে এক ছুটে সবাই চলে আসে নীলার কাছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন নীলা । শাহেদ গিয়ে নীলার হাত ধরে। কিন্তু নীলার চোখে তখন নেই মৃত্যুযন্ত্রণা – তাঁর চোখেমুখে তখন বিজয় আনন্দ , পাক হানাদারদের পরাজিত করতে পেরেছে ওরা । লাল -সবুজ শাড়ি রক্তে লাল হয়ে গেছে তখন। পরম পরিতৃপ্তির একটা হাসি মুখে নিয়ে শাহেদের দিকে তাকায় নীলা। দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে নীলার চোখ থেকে , জীবনের শেষ কান্না -শেষ দু ফোটা ভালবাসার অশ্রু , প্রিয় বাংলাদেশ টার জন্য ভালোবাসা , সহযোদ্ধাদের জন্য ভালোবাসা , মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভালোবাসা ।
আজ বিয়াল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে । অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর দেশ টা স্বাধীন হয়েছে , বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে পাক হানাদার দের কবল থেকে। কিন্তু ঐযে নীলা একদিন বলেছিল – রাজাকার দের থেকে সাবধান থাকার কথা -সেই রাজাকার রা রয়ে গেল বাংলাদেশেই। একদিন তারা সপরিবারে হত্যা করল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে। বাংলাদেশ আবার অগ্রসর হল অন্ধকারের দিকে। সে অন্ধকারের যুগে রাষ্ট্রক্ষমতায় এল একাত্তরের ঘাতক -দালাল রা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের উপর চালাতে লাগলো অত্যাচার , ইতিহাস কে বিকৃত করল , মুক্তিযুদ্ধ কে সরিয়ে দিল নাটক -সিনেমা থেকে। একে একে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মূলনীতির বিরোধিতা করল তারা। প্রতিবাদ করে উঠলেন একজন মা – রাজাকারের ফাসি চাইলেন , গনআদালত গড়লেন , রাজাকার সর্দার গোলাম আজমের জন্য ফাসির রায় এল গনআদালতের গণরায় থেকে । রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনল মা জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। মা লড়াই চালিয়ে গেলেন , মৃত্যুর আগে রেখে গেলেন শেষ চিঠি – “এ আন্দোলন কে সুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। আমি জানি জনগনের চেয়ে বিশ্বস্ত কেউ নেই। জয় আমাদের হবেই ।”
সেই অমর চিঠিকে বুকে নিয়ে বিয়াল্লিশ বছর পর জেগে উঠলো এক দল তরুণ । শাহবাগে আবার সমবেত হল তারা , মা জাহানারা ইমামের স্বপ্নকে সফল করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল । শাহেদ – কামাল -রশিদেরা এক বুক কষ্ট নিয়ে ততদিনে চলে গেছেন জীবন নদীর অপর পাড়ে । বেঁচে আছেন এই দলের আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাজেদা। ১৯৭১ সালে তাঁদের করা মীটিং – মিছিল -স্লোগান সব কিছু আবার ফিরে আসতে দেখেন তিনি ২০১৩ তে। শাহবাগে সমবেত জনতার মধ্যে তিনি দেখতে পান সেদিনের নীলা -শাহেদ কে , হাতে হাত রেখে তারা হাঁটছে কিন্তু প্রেমের গল্প করতে করতে নয় , স্বাধীন বাংলায় রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে একাত্ম হয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছে মিছিলে আজকের নীলা – শাহেদরা। শহীদ দীপ যে শপথ নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন , শহীদ নীলার ও তো সেই এক ই শপথ ছিল , শহীদ রুমি -বদি -আজাদ -আলতাফ মাহমুদের ও তো সেই এক ই শপথ ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদা বেগমের চোখে একাকার হয়ে যায় ১৯৭১ আর ২০১৩। ঝাপসা চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন অগ্রসরমান মিছিলের দিকে , চোখ থেকে গড়িয়ে পরে দুই ফোটা আনন্দাশ্রু – এই প্রজন্ম আবার জাগতে পেরেছে , বাংলার মাটিতে রাজাকারদের পরাজয় ঘণ্টা বেজে গেছে , এই বাঙ্গালিকে আর কেউ দমাতে পারবে না। সালমা এসব ভেবে আনন্দে কাঁদতে থাকেন , আর সমবেত জনতার সমাবেশ থেকে স্লোগান ওঠে – “লক্ষ শহীদ ডাক দিয়েছে , সব সাথীদের খবর দে – সারা বাংলা ঘেরাও করে , রাজাকারের কবর দে। ” দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলে শাহবাগের মিছিল , অনেক দূর পথচলা যে এখনও বাকি।
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু। জয় প্রজন্ম , জয় শহীদজননী , জয় প্রজন্ম চত্বর । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন