শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩

রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি , বাংলাদেশের নাম

গতকাল থেকে একের পর এক মুভি দেখছি । দেখলাম "গেরিলা" , "পলাশী থেকে ধানমণ্ডি" , "একাত্তরের যীশু" । মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা গুলো যতবার ই দেখি , নিজের অজান্তে চোখে পানি চলে আসে। এই মুভিগুলোর মধ্যে একাত্তরের যীশু বাদে বাকি সবগুলোই আগে অনেক অনেক বার দেখা , তারপরেও বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। বাঙ্গালি চিরন্তন সংগ্রামী জাতি - যার প্রমান ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬ ,১৯৬৯ , ১৯৭১ কিংবা ২০১৩। বার বার প্রতিপক্ষ কিন্তু সেই একই। পরাজিত হায়েনারা বার বার বাঙ্গালিকে আক্রমন করে ,নিঃশেষ করে দিতে চায় , কিন্তু বিপুল প্রানশক্তি আর দেশপ্রেমের অধিকারী বাঙালি জাতি যে হার মানতে শেখেনি । আর তাই বুকের রক্তে পিচঢালা রাজপথ , বাংলার সবুজ শশ্যক্ষেত রক্তিম করে তারা ছিনিয়ে আনেন বিজয় ।

আর সেইসব ত্যাগের সাক্ষী হয়ে , ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ বীরাঙ্গনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে যুদ্ধদিনের অসংখ্য স্মৃতিকথা - একাত্তরের দিনগুলি , একাত্তরের চিঠি ,মা , জোছনা ও জননীর গল্প , জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা এইসব বইগুলো আর আমার বন্ধু রাশেদ , গেরিলা , ওরা ১১ জন , পলাশী থেকে ধানমণ্ডি , একাত্তরের যীশু , হাঙ্গর নদী গ্রেনেড এইসব সিনেমাগুলো । আমি যখন যেই ব্যাপার নিয়ে পরতে বা মুভি দেখতে শুরু করি , যেই কয়টা হাতের কাছে পাই শেষ করে ছাড়ি। এস এস সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর বই পড়েছিলাম , বই কিনতে কিনতে আম্মু অস্থির হয়ে গিয়েছিল। এখন হটাত করে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মুভি দেখা। কিন্তু দুঃখের বিষয় , বর্তমানের নাটক -সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধকে কেমন যেন দূরে সরিয়ে রাখা হয় - কেন , সবাই কি পারেন না জাফর ইকবাল স্যারের মত করে খুব সাধারন একটা গল্পের মধ্যেও একটু করে হলেও মুক্তিযুদ্ধ কে নিয়ে আসতে ? ঈদের এত এত প্রোগ্রাম বানালেন এত এত টাকা খরচ করে , মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়টা প্রোগ্রাম হয়েছে ?

গেরিলা সিনেমাটায় মূলত অবরুদ্ধ ঢাকায় গেরিলাদের দুঃসাহসী মুক্তিযুদ্ধ আর আপামর জনতার সমর্থন ও সাহায্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি উঠে এসেছে পাকিস্তানি ও তাদের তাবেদার রাজাকার বাহিনীর বর্বরতার চিত্র। গেরিলা আমাদের দেখিয়ে দেয় পাকিস্তানিদের চোখে ধুলা দিয়ে কি পরিমান বিপদ মাথায় নিয়ে গেরিলারা একের পর এক অপারেশন পরিচালনা করে গেছেন। কিভাবে অবরুদ্ধ ঢাকায় আলতাফ মাহমুদ একের পর এক সুর বেধে গেছেন , কিভাবে জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিলকিস আর তার ভাবি পাক বাহিনীর ক্যাম্প উড়িয়ে দেয় , কিভাবে খবর পৌঁছে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের একজন থেকে আরেকজনের কাছে মিষ্টি বিক্রির আড়ালে , পাকবাহিনীর অত্যাচারের সামনে বীর আলতাফ মাহমুদ চিৎকার করে ওঠেন "আমি ই আলতাফ মাহমুদ" বলে। শহীদ রাজুর মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে কাঁদে তার গেরিলা বোন বিলকিস। ভাইয়ের লাশ নিতে আসার অপরাধে বিলকিসকে আর আরেকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে পাক সেনারা। পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করে একসময় মৃত্যুবরণ করতে হয় তাদের , কিন্তু মৃত্যুর আগে প্রতিশোধ নেয় বিলকিস , মরতে হয় তো একজন পাক হানাদার কে মেরেই তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ।

"পলাশী থেকে ধানমণ্ডি" এর আগে দেখেছিলাম গনজাগরন মঞ্চে ১৫ ই আগস্টের কর্মসূচী "উদিত সূর্য" তে। গতকাল আবার দেখলাম। আসলেই , ইতিহাস বার বার প্রত্যাবর্তন করে , সময়ের ধারাবাহিকতায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় । তা না হলে সেই মীরজাফরেরা কেন বার বার ফিরে আসে বাংলায় ? মীর জাফর খন্দকার মোশতাক হয়ে , মীর কাসেম , রাজবল্লভ , উমিচাদ , মীরনরা ফারুক , রশিদ , ডালিম , বজলুল হুদা , আজিজ পাশা হয়ে , জগৎশেঠ মেজর জিয়া হয়ে , গোলাম আজম হয়ে কেন বার বার ফিরে আসবে ? কেন বাংলার মাটি রঞ্জিত হবে জাতির পিতার রক্তে ? কেন ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল বাঁচার অধিকার পাবে না ? কেন ?? এত কেন এর কোন উত্তর নেই । আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি - এই বাংলাদেশের ই কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য । বঙ্গবন্ধু তো এই বাঙালি জাতিকে নিজের সন্তান বলতেন , আমরাও তো বঙ্গবন্ধুকে আমাদের পিতা বলি , তাহলে সেই অকৃতজ্ঞ সন্তানেরা কিভাবে পিতার বুকে গুলি চালিয়েছিল ? কোন উত্তর জানি না , শুধু জানি রাত পোহালে কখনই শোনা যাবে না বঙ্গবন্ধু মরে নাই , রাজপথে আর কখনও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই বলে মিছিল হবে না , আমরা কখনও আমাদের জাতির পিতাকে ফিরে পাব না , কক্ষনো না ...।

একাত্তরের যীশু দেখতে গিয়ে দেখলাম পাক বাহিনীর বর্বরতার আরেক দৃষ্টান্ত। গির্জার ভেতর লুকানো অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পেয়ে তারা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের । এ কাহিনীগুলো বইতে পড়ে কিংবা সিনেমাতে দেখেই আমার অন্তর কেঁপে উঠছে , আর এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা এত কিছু সহ্য করে , এত রক্ত দিয়ে , এত জীবন দিয়ে আমাদের জন্য এই বাংলাদেশটা এনে দিয়েছেন। মা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি তে পড়েছিলাম , একজন করে মানুষ কে ধরে নিয়ে গিয়ে সারা দেহ থেকে রক্ত বের করে নিত ওরা সিরিঞ্জের সাহায্যে , মসজিদে ঢুকে ইমাম কে গুলি করে মেরেছে ওরা , কুরান পাঠরত মহিলার কাছ থেকে কুরান কেড়ে নিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেছে , হত্যা করেছে। কোন বর্বরতার সাথে তুলনা দেব এই পাক বাহিনীর ? হিটলারের চেয়েও এরা হিংস্র , ভয়ঙ্কর পশু।

১৯৭১ এর ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ বীরাঙ্গনার রক্তের ঋণ চিরকাল আমাদেরকে ঋণী করে রাখবে । এই মুক্তিযোদ্ধারা , বীরাঙ্গনারা আমার বাবা- মা -ভাই -বোন , আমার পরিবার - বাঙালি পরিবার। যারা আমার মা -বাবাকে হত্যা করেছিল , ধর্ষণ করেছিল আমার মা কে , বোন কে আমি কখনও তাদের ক্ষমা করব না । আমার জন্মদাত্রী মা আমার যতটা ভালোবাসার , যতটা আপন , এই মুক্তিযোদ্ধারা , শহীদেরা , বীরাঙ্গনারাও ঠিক ততটাই । রাজাকারের ফাসির দাবি জানিয়ে যাব যতদিন দেহে প্রান থাকবে । এই দাবি করতে গিয়ে যদি আরও আক্রমন হয় তো হোক না। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চিৎকার করে যাব জয় বাংলা বলে। সাদা পোশাক রক্তে লাল হয়ে যাবে তো যাক না , সেই রক্ত দিয়েই লিখে যাব একটি নাম , রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের নাম ।

জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু। জয় প্রজন্ম , জয় শহীদজননী , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন