শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ , চুনি উঠলো রাঙ্গা হয়ে

  1. জীবনের প্রতি পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকে যুদ্ধের ইতিহাস , সাদা - কালো পাতা রং তুলির ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে জীবন্ত। কখনও সে রং বিপ্লবের ,আবার কখনও বা বন্ধুত্বের, কখনও প্রেমের , কখনও বা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। প্রতিটা ইট -কাঠ কিংবা পাথরের মাঝে লুকিয়ে থাকে এক একটি জীবন যুদ্ধের ইতিহাস, নরম সবুজ পলিমাটির বুকে চিরন্তন পথচলায় মাটির বুকে পায়ের ছাপ থেকে যায় অন্ধকারে খাঁ খাঁ সীমান্তে বুকে হেঁটে শত্রুর আস্তানার দিকে ছুটে... যাওয়া মুক্তিসেনার। বন্ধুর হাতে তারার মত জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার যে শহীদ বন্ধুর রক্তের দামেই লেখা। কিংবা কোন এক নিভৃত পল্লীতে ছোট্ট কুঁড়েতে বসে স্বামী- হারা , সন্তানহারা মা গোনেন অপেক্ষার প্রহর। মায়ের একজন সন্তানের মৃতদেহের উপরে তত দিনে জমা হয়ে গেছে আরও শত শত সন্তানের মৃতদেহ। স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে , খুনির ফাঁসি হয়েছে - পার হয়ে গেছে অনেকটা সময়।

    বিয়াল্লিশ দিন , বিয়াল্লিশ মাস , বিয়াল্লিশ বছর চলে যায় , মায়ের অপেক্ষার প্রহর যে আর শেষ হয়না। "আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়" বলে যে সন্তান মুক্তির সংগ্রামের সন্ধানে ঘর ছেড়েছিল - নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনে মুক্ত করেছিল বাংলার মাটিকে, নিস্তব্ধ রাতের নীরবতা ভেদ করে শত্রুর বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেছে তার বুক। মা , মা করে ষোল বছর বয়সের সেই কিশোর টি আর ছুটে আসবে না দুঃখিনী মায়ের কোলে , যেমনভাবে আর কখনও মায়ের কোলে ফিরে আসবে না ক্র্যাক প্লাটুনের শহীদ দুর্ধর্ষ গেরিলারা। "আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়" -হ্যা বাংলায় বারবার ফিরে আসেন বটে শহীদ রুমী - বদি -আজাদ - আলতাফ মাহমুদ , কখনও পুলিশের উদ্যত অস্ত্রের মুখে জয় বাংলা স্লোগানে রাজপথ কাঁপানো তরুণী হয়ে , কখনও রাতের অন্ধকার ভেদ করে রাজাকারের আস্তানায় হানা দিয়ে "রাজাকার" তিলক পরিয়ে আসা অকুতোভয় তরুণ হয়ে। 

    শহীদ ভাইয়ের ছবি বুকে নিয়ে অশ্রুজলে ভাসে বোন , বেঁচে থাকলে কত বড় হত ভাইটি এখন? ভাইটির কি বিয়ে হত? কেমন হত ভাবীটা? ওদের বাচ্চাটাই বা কেমন হত? অশ্রুজলে ঝাপসা চোখে সামনে তাকিয়ে বোন দেখতে পান লাল -সবুজ পতাকা মাথায় বেঁধে প্রজন্ম চত্বরের মিছিলে ছুটে যাওয়া নিজের সন্তানকে। বিয়াল্লিশ বছর আগে তার কিশোর ভাইটিও তো এভাবেই মিছিলে ছুটে যেত "জয় বাংলা" বলে। সন্তানের মুখে সেই বোন আজ খুঁজে পান একাত্তরে শহীদ ছোট্ট ভাইটিকে। বেঁচে থাকলে হয়ত একাত্তরের ১৬ ই ডিসেম্বরে একইভাবে বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরত ভাইটি, যেমন করে ফিরে এসেছিল ওর সব বন্ধুরা - শুনিয়েছিল রণক্ষেত্রে শহীদ ভাইয়ের অপরিমেয় বীরত্বের কাহিনী। ওরা ই বিজয়ী , যুগে যুগে এই খ্যাপাটে তারুন্যই বিজয়ী , এই পাগল ছেলেমেয়েরাই বিজয়ী। কি বায়ান্নতে , কি উনসত্তরে , কি একাত্তরে , কি ২০১৩ তে ।

    প্রত্যেকটা ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে থাকে হাজার হাজার নীরব ভাষায় আত্মত্যাগের ইতিহাস। প্রত্যেকটা যুদ্ধকে বিশ্লেষণ করলে তার মাঝে থেকে উঠে আসে আরও লক্ষ কোটি যুদ্ধের ইতিহাস। লাল -সবুজ ইতিহাসের প্রতি পাতায় মিশে থাকে শহীদের রক্ত , মায়ের কান্না , বোনের বিসর্জন আর বীরাঙ্গনার বুক ফাটা আর্তনাদ। কখনও বা হানাদারদের ভয়ে লুকিয়ে থাকা সবাইকে বাঁচাতে মা বিসর্জন দেন কোলের শিশুকে , কখনও বা নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশ্বাস দূরে সরিয়ে দেয়া সন্তানকে মা বলেন - "যা তোকে দেশের জন্য কুরবানী করে দিলাম। যা , তুই যুদ্ধেই যা।" ভাষা আন্দোলনের উত্তাল রাজপথ ধরে একদিন আসে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার, মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তে ভেজা পথ বেয়ে একদিন আসে স্বাধীনতা , প্রজন্ম চত্বরের আগুনঝরা মিছিলের হাত ধরে একদিন কলঙ্কমুক্ত হয় বাংলাদেশ। এই বিজয় , এত রক্তের দামে , এত অশ্রুর দামে এই বিজয় কিনতে হয় যে বিজয়ানন্দ হারিয়ে যায় অশ্রুর অন্তরালে।

    নিঝুম নিস্তব্ধ বন -বনানী , পদ্মা -মেঘনা - যমুনার উতরোল কোলাহল আর অসীম নীলাকাশ ছাপিয়ে শোনা যায় তারুন্যের মহাসমুদ্রের উত্তাল গর্জন , সেই মহান স্লোগান "জয় বাংলা" চিৎকার ছাপিয়ে যায় জনকোলাহলে ভরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে। পথে পথে আজ উত্তাল জনমিছিলে রবিঠাকুরের লেখা সেই অমর জাতীয় সঙ্গীত - "আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালোবাসি।" হটাত নিরীহ মাটিতে জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান , গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশ। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ বীরাঙ্গনা মায়ের বাংলাদেশ , বীর মুক্তিসেনার বাংলাদেশ , বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ , শহীদজননীর বাংলাদেশ , প্রজন্ম চত্বরের ডাকে ঘরছাড়া যোদ্ধার স্বপ্নের বাংলাদেশ। কবিরা কি আসলেই ভবিষ্যতদ্রষ্টা হন ? স্বাধীনতা যখন শুধুই স্বপ্ন - তখনই তো রবিঠাকুর লিখেছিলেন- "আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ , চুনি উঠলো রাঙ্গা হয়ে।"

    জয় বাংলা...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন