বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৩

শাহবাগে রাত ভোর , স্মৃতিতে একাত্তর - নব ইতিহাসের সাক্ষী রইল প্রজন্ম চত্বর

একটি কিশোরী মেয়ে , নাম মুক্তি , পড়ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস । কি অবাক করা ইতিহাস এই বাংলাদেশটার -প্রতি পদক্ষেপে লড়াই এর এমন ইতিহাস সারা পৃথিবীতে আর কোন জাতির নেই । ভাষার জন্য , দেশের জন্য , নিজেদের অধিকারের জন্য , বেঁচে থাকার জন্য , দুমুঠো অন্নের জন্য ,এমন কি প্রান খুলে নিজেদের প্রিয় বাংলাদেশের বিজয়ের স্লোগান "জয় বাংলা " বলার জন্য ও বার বার সংগ্রাম করতে হয়েছে বাঙ্গালিকে । এত রক্ত , এত যুদ্ধ , এত সংগ্র...ামের ইতিহাস এই বাঙ্গালির -এত প্রানশক্তি এই বাঙ্গালির । এই ইতিহাস পড়তে গিয়েই মেয়েটি জানতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা - ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা -বোনের আত্মদানের কথা । কিশোরী মেয়েটির কি হয় -সে নিজেকে কল্পনা করতে থাকে সেই বোনের জায়গায় , হাসিমুখে ভাইকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিল যে , আজও যেই বোন তার ভাইএর কবর টুকুও খুঁজে পায়নি । নিজেকে কল্পনা করে সেই মা এর জায়গায় , নিজের চোখের সামনে নিজের শিশু সন্তান কে পাকিস্তানিদের বেয়নেটে মারা যেতে দেখেছেন যিনি , সেই মা এর জায়গায় - শিশু কান্না করলে আশেপাশের সবাই একসাথে ধরা পরে যাবে পাকিস্তানিদের হাতে বুঝতে পেরে যেই মা শিশু সন্তানের মুখ চেপে ধরেছিলেন , পাকিস্তানিরা চলে গেল , সবার জীবন রক্ষা হল -কিন্তু শিশুটি মারা গেল । কিংবা তার সমবয়সী সেই বীরাঙ্গনার জায়গায় , বাঙালি হবার অপরাধে হানাদার রা যার উপর চরিতার্থ করেছে নিজেদের পাশবিক লালসা- মৃত্যুর আগে নিজের রক্ত দিয়ে টর্চার সেলে যে মেয়েটি লিখেছিল জয় বাংলা । এইসব আত্মদানের কথা স্মরন করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই কখন মুক্তির চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে সে জানে না ।

ইতিহাসের পাতা উল্টাতে থাকে মুক্তি । মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে গিয়ে জানতে পারে এক অদ্ভুত প্রজাতির কথা -যার নাম রাজাকার । সহজ কথায় বলতে গেলে , বাংলাদেশ যদি মা হয় তাহলে সন্তান হয়ে সেই বাংলা মাকে ধর্ষণ করেছিল যারা তারাই রাজাকার । সারা বাংলাদেশের মানুষ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য , পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য লড়াই করছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে -কেউ অস্ত্র হাতে , কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে , কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে , কেউ নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে -তখন কিছু এদেশীয় কুলাঙ্গার উঠে -পরে লেগেছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের সাহায্য করতে । গোলাম আজম ছিল এই রাজাকারদলের নেতা। সারা বাংলাদেশ থেকে শিক্ষক -সাহিত্যিক -বুদ্ধিজীবীদের খুজে খুজে বের করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল এরা। কোন বাসায় কে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে এত খবর পাকিস্তানিদের পক্ষে রাখা সম্ভব ছিল না , আর সেই কাজ টাই পুরন করে দিতে এসেছিল এই বাংলাদেশের ই কিছু কুলাঙ্গার । সারা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের উপর তারা অত্যাচার -নির্যাতন -খুন -ধর্ষণ চালিয়েছে , মুক্তিযোদ্ধাদের এনে ধরিয়ে দিয়েছে পাক বাহিনীর হাতে , বাঙালি মেয়েদের খুজে বের করে পাক হানাদার দের হাতে তুলে দিয়েছে ।

এত কিছুর পর ও , এত বাধার পর ও -বাঙালি তো হার মানার জাতি নয় । বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চলতে থাকে , শহরে -বন্দরে , গ্রামে -গঞ্জে বাঙালি মুক্তিবাহিনী , গেরিলা বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমনের মুখে মুহূর্তে মুহূর্তে পরাজিত হতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী । ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতীয় মিত্রবাহিনী যুক্ত হয় পাকিসাত্নিদের যম বাঙালি মুক্তিবাহিনীর সাথে। চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে পাকিস্তানিরা বাস্তবায়ন করে যায় এই বাংলাদেশ কে মেধাশুন্য করার এক নীল নকশা । আল্ বদর , আল শামস , রাজাকার রা ধরে আনে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষক -সাংবাদিক -সাহিত্যিক -বুদ্ধিজীবীদের । আত্মসমর্পণের আগে বাঙ্গালিদের মেধাশুন্য করার এই ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যায় পাকিস্তানি বাহিনী । ১৬ ই ডিসেম্বর , ১৯৭১। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী । বাংলার আকাশে উদিত হয় লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বিজয় সূর্য ।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় দেশ গড়ার সংগ্রাম । যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ টাকে সন্তান স্নেহে যখন গড়ে তুলছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , তখন ই একাত্তরের পরাজিত শক্তি আবার আঘাত হানে । সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা , দেশের বাইরে থাকার কারনে বেচে যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা । মুক্তি অনেক ভেবেও বুঝতে পারেনা -বাঙ্গালিকে তো বঙ্গবন্ধু নিজের সন্তান বলতেন , কোন সন্তান কিভাবে বাবার বুকে অস্ত্র চালাতে পারে ? মেজর বজলুল হুদা কিভাবে পেরেছিল পিতা বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি চালাতে ? সন্তান কি বাবাকে খুন করতে পারে ? স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণায় ভরে ওঠে মুক্তির মন , অশ্রুশিক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ শরীরের ছবিটার দিকে চেয়ে থাকে মুক্তি ।

এরপর ? বঙ্গবন্ধু কে হত্যার পর বাংলাদেশ অগ্রসর হয় ইতিহাসের গভীরতম কালো অধ্যায়ের দিকে। রাজাকার নামক যে দানব গুলো ছিল তারা মন্ত্রী হয় , গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় ।১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা , বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা জেলের গাড়ি থেকে সে দৃশ্য দেখতেন । মা জাহানারা ইমাম এই কুলাঙ্গার রাজাকার দের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন প্রথম । তিনি গন আদালত গঠন করে গন রায়ের ব্যবস্থা করেন যেখানে রাজাকার কুল শিরোমণি গোলাম আজমের ফাসির রায় দেয়া হয় । কিন্তু স্বাধীনতা বিরধি অপশক্তি তখন ক্ষমতায় । মা জাহানারা ইমাম কে হতে হয় দেশ ছাড়া । অনেক বছর পরে ২০১০ সালের দিকে আবার রাজাকারের বিচার কার্যক্রম শুরু হয় স্বাধীন বাংলার মাটিতে । এই বিচার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের কসাই এর রায় দেয়া হয়। কিন্তু রায় টা ফাসি না হয়ে হয় যাবজ্জীবন । বিজয় চিহ্ন দেখায় কাদের কসাই ...।।

মুক্তি আর সহ্য করতে পারেনা । খুব ই সাধারন একটা মেয়ে মুক্তি , কলেজে যাওয়া , পড়াশুনা করা এসবের মধ্যেই তার গণ্ডি সীমাবদ্ধ । কিন্তু নিজের অন্তরে এবার প্রতিবাদের একটা তাগিদ অনুভব করে মুক্তি -এরকম তো আর কখনও হয়নি ! দেশের অনেক সমস্যা এর আগে অনেকবার মুক্তিকে ভাবিয়েছে , কিন্তু প্রতিবাদ করার এমন তীব্র আর্তনাদ তো নিজের মধ্যে আর কখনও অনুভব করেনি মুক্তি ! কি করা উচিত তার এখন ? এসব ভাবতে ভাবতে সে জানতে পারে , এই আর্তনাদ তার একার নয় , বাংলাদেশের আরও লক্ষ তরুন প্রানের , শাহবাগে তারা ইতিমধ্যেই অবস্থান নিয়ে রাজাকারের ফাসির দাবিতে আন্দোলন করছে। খবরটা শুনে এক মুহূর্তে মুক্তির মন থেকে সব দ্বিধা -সংশয় দূর হয়ে যায় । মুক্তি বুঝতে পারে তার অন্তরের দাবি কি , সেই দাবি জানানোর জন্যই মুক্তি যায় শাহবাগে । সেখানে জাগ্রত অসঙ্খ্য তরুন সহযোদ্ধার প্রতিবাদী স্লোগানের কণ্ঠস্বরে মিশে যায় মুক্তির কণ্ঠস্বর । একদিকে পরিবারের বাধাধিতআপন সব মানুষ জনের উপেক্ষা , একে একে দূরে সরে যাওয়া , সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর বিরোধিতা , কলেজ থেকে শাস্তি পাওয়া - আর এই সবকিছুর বিপরীতে প্রানের শাহবাগ । মুক্তির ঠিকানা আজ শুধুই শাহবাগ । কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি , রাজাকারের ফাসির দাবিতে রাতদিন শাহবাগে অবস্থান -মীটিং -মিছিল - পরিবারের সবচেয়ে বাধ্যগত -অনুগত মুক্তির মহ্যে কি অদ্ভুত পরিবর্তন ! কোন বাধাই আজ তার কাছ বাধা নয় , ইতিহাসের দায় শোধ করে , রাজাকারের ফাঁসি নিয়ে তবেই সে ঘরে ফিরবে । এক একটা ফাসির রায়কে মুক্তির মনে হয় এক একটা বাধাকে পরাস্ত করা , এক একটা অপমানের , এক একটা শাস্তির প্রতিশোধ নেয়া ।

জয় বাংলা । জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় জনতা , জয় গনজাগরন মঞ্চ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন