মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

আমি দেখিনি একাত্তর , দেখেছি শাহবাগ - নবীনের জাগরণে বাংলাদেশ হতবাক !

প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ , প্রাণের শাহবাগ আন্দোলন - নয় মাস পার হয়ে গেল কেমন করে, তাইনা? শাহবাগের এই নয় মাস আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নয়টি মাস - মুক্তিযুদ্ধের বিয়াল্লিশ বছর পর এক ই চেতনায় বাঙ্গালির জাগরণের নয়টি মাস - জামাত -শিবির যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালির স্মরণাতীত জাগরণের নয় মাস। শাহবাগ এখন শুধু একটা জায়গার নাম নয় - এটি এখন একটা চেতনার নাম , একটা মুক্তির নাম  একটা ভালোবাসার নাম। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর - নামটা উচ্চারন করার সাথে সাথে অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করে চোখের সামনে- সে স্মৃতি আন্দোলনের, সংগ্রামের। সে স্মৃতি মিছিল- স্লোগানে উত্তাল রাজপথ প্রকম্পিত করে রাখার। সে স্মৃতি তরুণ - তরুণী , কিশোর - কিশোরী , বৃদ্ধ - বৃদ্ধার মুখে দ্বিধাহীন জয় বাংলা ধ্বনির। সে স্মৃতি জাগরনের , সে স্মৃতি দাবি জানানোর , দাবি আদায়ের। নয় মাস ধরে চলা শাহবাগ আন্দোলনের দিনগুলোকে পর পর সাজাতে চেষ্টা করলাম এই লেখায়। এই শাহবাগ যে একটা জীবন্ত ইতিহাস , ইতিহাসের ধারক হয়ে শাহবাগের দিনগুলো বেঁচে থাকবে সারাজীবন।

  • ৫ ফেব্রুয়ারি ,২০১৩

কিছুদিন আগেই বাচ্চু রাজাকারের রায় হয়েছে ফাঁসির। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোন রাজাকারের ফাসির রায় দেয়া হয়েছে। সকালে কলেজে যাওয়ার আগে পেপারে খবর টা দেখে খুবই খুশি হয়েছিলাম। অবাক লেগেছিল এই ভেবে যে আসলেই বিয়াল্লিশ বছর পর এই প্রথম কোন রাজাকারকে ফাসির রায় দেয়া হল। সেদিন থেকেই খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম এর পরে আর রাজাকারের রায় কবে হবে। ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে শুনলাম সেদিন কাদের কসাই এর রায় দেয়া হবে। অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন রায় আসবে। রায় দুপুরে দেয়া হলেও আমি রায়টা জানতে পেরেছিলাম রাতে। ফাসি হয়নি , যাবজ্জীবন হয়েছে শুনে এত কষ্ট পেয়েছিলাম যা বলার মত না। কিন্তু আমি তখনও জানি না কি করা উচিত এখন। নিজের মধ্যে থেকেই অনুভব করছিলাম রাস্তায় নামার তাগিদ , কিন্তু কিভাবে কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল এই রাজাকারের ফাসির রায় না হওয়া মানে জাতির একটা বড় পরাজয়। এটা হতে দেয়া যাবে না। এই অনুভব নিয়েই ৫ ফেব্রুয়ারি দিন টা শেষ হল।

  • ৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৩

সকালে উঠেই শুনতে পেলাম আমাদের মত সাধারন মানুষেরাই শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন , রাজাকারের ফাসির দাবিতে আন্দোলন চলছে শাহবাগে। জীবনে এর আগে কখনও মিছিল - অবস্থান কিছুতে যাওয়ার কথা আমার কল্পনার ও অতীত ছিল। কিন্তু এখন শাহবাগে যেতে হবে - এই তাগিদ অন্তর থেকে অনুভব করছিলাম। পেপারে শাহবাগের খবর পড়তে পড়তে আর মাএর সাথে এই নিয়ে আলোচনা করতে করতে একসময় রাজি করিয়ে ফেললাম শাহবাগে যাওয়ার কথা। মা যাওয়ার আগে বললেন , তোমার বাবাকে জানিও না। আমি বোকা মেয়ে , বুঝতে পারলাম না শাহবাগে যাওয়ার কথা বাবাকে না জানানোর কি আছে। পরে মা বলেছিলেন - একবার নির্বাচনের সময় মা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন বলে বাবা অনেক রাগারাগি করেছিল মা এর সাথে। এরপর আর কখনও ভোট দিতে যেতে দেয়নি মা কে , কারন আমার মা সবসময় ই নৌকা মার্কার ভোটার। যাই হোক , এসব আলাপ করতে করতে একসময় শাহবাগে চলে আসলাম। সেখানে তখন বিশাল জনস্রোত। দেখতে দেখতে এই জনজোয়ারের অংশ হয়ে গেলাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম স্লোগানরত অবস্থায়। চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ - সবাই একে অপরের সহযোদ্ধা , খাবার -পানি সবাই ভাগ করে খাচ্ছি - প্রত্যেকটা আন্দোলনকারী সচেষ্ট অন্য সহযোদ্ধার যাতে কোনোরকম সমস্যা না হয়। এরকম সহযোগিতা - সহমর্মিতায় ভরা শাহবাগের প্রত্যেকটা মানুষ , আমার প্রিয় সহযোদ্ধারা।

  •  ৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৩

ততক্ষনে শাহবাগের সাথে একাত্ম হয়ে গেছি অন্তর থেকে। কলেজের সময়টুকুর জন্য শাহবাগ থেকে কলেজে আসি , কলেজ শেষে আবার শাহবাগ। এর মধ্যে একদিন ঠিক করলাম কলেজ থেকে অনেকে মিলে একসাথে শাহবাগ যাব। সবাইকে বলতে শুরু করলাম - কারো কাছে অনেক ভাল রেস্পন্স পেলাম , আবার কিছু মেয়ের কাছে শুনলাম -"নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কি দরকার?" তখন বুঝতাম না যে এইসব মানুষ দেরকে বুঝিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয়না। সেই সহপাঠীদেরকে বোঝাতে শুরু করলাম শাহবাগ সম্পর্কে। এর মধ্যেই সিস্টারদের কাছে কমপ্লেইন করল কেউ একজন। সিস্টার প্রথমে স্বীকারোক্তি লিখতে বললেন - আমি বুঝলাম না কি অপরাধ করেছি যে স্বীকারোক্তি লিখতে হবে। যাই হোক , লিখলাম যে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বদলা নিতে চাই বলে শাহবাগ যাই। এই লেখা দেখে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন সিস্টার - মা কে ডেকে বললেন আমি নাকি কলেজে রাজনীতি প্রবেশ করাচ্ছি। সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করা হল আমাকে। খারাপ লাগলেও এক দিক দিয়ে খুশি হয়েছিলাম সেটা হল - একটানা শাহবাগে থাকতে পারব। ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বহিষ্কৃত ছিলাম - একটানা থেকেছি শাহবাগে। মা আমাকে কখনও পাশের বাসায়ও একা যেতে দেননা , কিন্তু শাহবাগে আমাকে একা রেখে মা বাসায় আসতে পেরেছিলেন - কারন শাহবাগ আমাদের তীর্থস্থান , প্রত্যেকটা মানুষ শাহবাগে একে অপরের ভাই -বোন , সহযোদ্ধা। স্লোগানে স্লোগানে কেটে গেল ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনগুলো।

  • ১৪ ফেব্রুয়ারি ,২০১৩ - ২১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৩

শাহবাগে চলতে থাকল অবস্থান - স্লোগান। কলেজের সময়টা বাদে আর বাবা বাসায় থাকে এমন সময়টুকু বাদে বাকি সবসময় আমি শাহবাগে। বাসায় যতক্ষণ থাকি , অনলাইনে জামাত -শিবিরের নানা রকম অপপ্রচারের জবাব দিতে থাকি। এর মধ্যে শাহবাগে আমরা শপথ নিয়েছি , একসাথে কোটি মোমবাতির আলোয় আলোকিত করেছি আমাদের শাহবাগ কে। স্লোগান দিতে দিতে মারা গেছেন তরিকুল ইসলাম শান্ত, শিবিরের আক্রমনে শহীদ হয়েছেন রাজীব হায়দার। ২০ ফেব্রুয়ারি চিঠি ওড়ানো হল শহীদদের স্মরণে। এই কর্মসূচীগুলোর অনেকে অনেক রকম সমালোচনা করেন আমি জানি - কিন্তু এই কর্মসূচীগুলো পালন করতে গিয়ে নিজের বুকের ভেতর যে আগুন অনুভব করেছিলাম তার সাথে আর কিছুর তুলনা হয়না। একাত্তর দেখিনি আমি , শাহবাগ দেখেছি । এত মানুষ একসাথে শপথ নেয়া , মোমবাতি জ্বালানো , শহীদদের উদ্দেশ্য করে চিঠি পাঠানো , তিন মিনিটের জন্য সারা বাংলাদেশ নীরব হয়ে যাওয়া - এসবের মধ্যে যেন না দেখা একাত্তর কে খুজে পেয়েছিলাম। প্রতিপক্ষ তো সেই এক ই, চেতনাও সেই এক ই , স্লোগান সেই এক ই।

  • ২৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৩

সাইদি নামক কুলাঙ্গার রাজাকারটার ফাসির রায় হল সেদিন। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি খুশির দিন ছিল মনে হয় এই ফাসির রায়ের দিনটা। কারন এর আগে কখনও আন্দোলন করে রাজাকারের ফাসির রায় আদায় করে নেব এ কথা ভাবি নি। কাদের কসাই এর ফাসির রায় না হওয়ার কষ্টের উপর একটা সুখের প্রলেপ নিয়ে আসলো সাইদির ফাসির রায়। এর মধ্যে আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কসাই কাদেরেরও ফাসির রায় হবে।বাঙ্গালির হাত থেকে সে বাঁচতে পারবে না - এই বিশ্বাস অন্তরে। এক একটা রাজাকারের ফাসির রায় মানে আমাদের এক একটা বিজয়।

  • ৭ মার্চ , ২০১৩

১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ ফিরে এল শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে ২০১৩ সালের ৭ ই মার্চ হয়ে। ছোট্ট শিশুর মুখে শাহবাগ শুনল , বাংলাদেশ শুনল , সারা পৃথিবী শুনল বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চ , ১৯৭১ এর ভাষণ। এই ভাষণ যে বাঙ্গালির স্বাধীনতার ডাক , বাঙ্গালির মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সূচনা যে বঙ্গবন্ধুর এই ৭ ই মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়েই। বিয়াল্লিশ বছর পর এই প্রজন্মের শিশুর মুখে আবার বাংলাদেশ শুনল সেই অমর অক্ষয় আহবান - "তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা , রক্ত যখন দিয়েছি , রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম , আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম , স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।"

  • ৬ এপ্রিল , ২০১৩

হেফাজতে ইসলাম নামক একটা সংগঠনের আবির্ভাব ঘটল কোথা থেকে যেন। তারা শাহবাগের সবাইকে নাস্তিক ঘোষণা করল আর শাহবাগ আক্রমনের ঘোষণা দিল। ব্লগিং করা তাদের কাছে অপরাধ , শাহবাগ যাওয়া তাদের কাছে অপরাধ। কিন্তু বাঙালি তো হার মানবার জাতি নয়। আমরা শাহবাগের প্রত্যেকটা আন্দোলনকারী জানি যে আমরা রাজাকারের ফাসির দাবিতে শাহবাগে আসি - এর সাথে নাস্তিকতার কোন সম্পর্ক নেই। ব্যাক্তিগতভাবে কে কোন মতের অনুসারী তা নিশ্চয় সামষ্টিক একটা আন্দোলনের চিন্তার বিষয় হতে পারেনা। যাই হোক , সেদিন বাশের লাঠি হাতে শাহবাগে ছিলাম আমরা। জীবনে প্রথম কারো বিরুদ্ধে এভাবে প্রতিরোধ করা। মা সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তার শান্ত -শিষ্ট মেয়েটির দিকে। সারাক্ষন পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকা এই মেয়ে কিনা লাঠি হাতে হেফাজতের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় , জামাত -শিবির - রাজাকারদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়।

  • ৫ মে , ২০১৩

আবার সেই হেফাজত। এবার তারা ঘোষণা দিল ঢাকা অবরোধের। আইন -শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেদিন অনেক বেশি সহ্য করেছিলেন আসলে অনেক আগেই এদেরকে উঠিয়ে দেয়া উচিত ছিল সেদিন - টেলিভিশনে দাউ দাউ করে সিপিবি কার্যালয় এ আগুন , রাস্তায় বই -পত্রে আগুন , কুরান শরিফে আগুন দেখে মনে হচ্ছিল যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি কি আবার ২৫ শে মার্চ শুরু করল নাকি? এত আগুন কেন? পরদিন সকালে জানতে পারলাম একসময়ের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবির আসল রূপ। জানতে পারলাম তার ভাই শিবিরকর্মী , হেফাজতের সমাবেশে মারা গেছে। আমাকে সে বিশ্বাস করানোর আপ্রান চেষ্টা করল যে সেই রাতে কত কত হাজার মানুষ মারা গেছে। এই মেয়ে একদিন বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখত। আমি বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়েই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে খামোখা এইসব মিথ্যা কথা বলে আমাকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর থেকে সে সরাতে পারবেনা। অনেক অনেক দিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি তুই যেটা করছিস সেটা ভুল , তোর ভাই ভুল পথে গিয়েছে দেখে তুই ও কেন যাবি - কিন্তু ব্রেইনঅয়াশ করা মানুষ কে ঠিক পথে ফেরানো যায় না। প্রতিদিন শাহবাগ নিয়ে তর্ক - বিতর্ক হতে হতে একসময়ের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবি হয়ে গেল আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। অনবরত কমপ্লেইন করতে থাকল সে আমার নামে সিস্টারের কাছে , শাস্তিও পেতে থাকলাম একের পর এক। খুব কম দিন গিয়েছে যেদিন সিস্টারের কাছে শাহবাগ নিয়ে কোন না কোন কথা আমাকে শুনতে হয়নি।

  • ২৮ জুন , ২০১৩ 

মে মাসেই কামরুজ্জামান নামক কুলাঙ্গারটার ফাসির রায় হয়ে গেছে। এরপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। কাদের কসাই এর ফাসির রায়ের কোন খোঁজ - খবর নেই তখনও। জামাত নিষিদ্ধের কতদুর অগ্রগতি হল তাও জানি না। এরকম একদিন ঠিক করলাম আবার জাগতে হবে আমাদের , জাগাতে হবে শাহবাগকে। আবীর , অর্ণব কয়েকজনের পোস্ট দেখলাম - আবার যদি শাহবাগ জাগে তাহলে সাথে থাকবেন কিনা এই প্রশ্ন করে পোস্ট। তাদের সাথে আলাপ করে খুলে ফেললাম ২৮ জুন তারিখে শাহবাগে মানববন্ধনের ইভেন্ট। এরপর পুরো জুন মাসটাই গেল এই ইভেন্টের প্রচারনা চালাতে , ইভেন্টটাকে বাস্তবে মাঠে নামিয়ে আনতে কত ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তা আমরা পর্দার পিছনের মানুষগুলোই জানি। সেদিন অনেকদিন পর শাহবাগে আবার ফিরে পেয়েছিলাম সেই ফেব্রুয়ারি মাসের আগুনঝরা দিনগুলো । সেই অমর স্লোগান - "আর কোন দাবি নাই , রাজাকারের ফাসি চাই।" আমাদের সেদিনের মানববন্ধন থেকে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় - "গোলাম আজমের রায় হবে কবে? কাদের কসাই এর আপিলের রায় হতে আর কত দেরি? জামাত নিষিদ্ধের অগ্রগতি কতদুর?" সেদিন আমরা দেখিয়ে দিতে পেরেছিলাম শাহবাগ জেগে আছে , শাহবাগ ঘুমায় না - ঘুমাতে জানেনা। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ থামবে না।

  • ১৭ জুলাই , ২০১৩

গোলাম আজম নামক রাজাকার প্রধানের রায় হল , কিন্তু রায়ে ফাসি হল না। বিক্ষোভে ফেটে পরল শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর। ঠিক তার পরদিন মুজাহিদ কুলাঙ্গার , শহীদ রুমি - বদি -আজাদ -আলতাফ মাহমুদ - জুয়েলের খুনি মুজাহিদের ফাসির রায় হল। আনন্দে হেসে উঠলো সারা জাতি। মা জাহানারা ইমামের সন্তান শহীদ রুমি হত্যার প্রতিশধ নেয়া হল - মুজাহিদ কুলাঙ্গারের ফাসির রায় হল। এর মধ্যেও আন্দোলন চলতে থাকল গোলাম আজমের ফাসির রায়ের দাবিতে। একদিন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আপিল করা হল গোলাম আজমের এই রায়ের বিরুদ্ধে - দাবি করা হল ফাসির। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম গোটা জাতি। সবার ফাসির রায় হয়ে এই গোলাম আজম যদি বেঁচে যায় সেটা অনেক লজ্জাজনক ব্যাপার হবে আমাদের জন্য। আর তাই গোলাম আজমের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শান্তি এনে দিল অন্তরে। বয়স বিবেচনায় এই খুনিকে মাফ করা যাবে না। গোলাম আজমের যাবজ্জীবন রায়ের পর শাহবাগে বিক্ষোভে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম রঞ্জু আঙ্কেল বলেছিলেন - " পনের বছর বয়সে আমি যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছি তখন পাকিস্তানিরা বা রাজাকার রা যদি আমাকে ধরতে পারত তারা কি আমাকে বয়স বিবেচনা করে মুক্তি দিত? তাহলে এখন কিসের বয়স বিবেচনা?" আপিল হয়েছে , ফাসির রায় হবে সেই আশায় আছি আমরা এখনও।"

  • ২০ জুলাই , ২০১৩ 

হেফাজতে ইসলাম এর প্রধান আহমদ শফি নারী জাতিকে চরম অবমাননা করে বক্তব্য দিল । চরম বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক এই বক্তব্যের প্রতিবাদে জেগে উঠলাম আমরা। শাহবাগে মানববন্ধন করলাম শফির নারীবিদ্বেষী কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে। সেদিন কলেজে ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা ছিল - কিন্তু শাহবাগ আমার কাছে সবসময় ই জীবনের অন্য সবকিছুর চেয়ে অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ। কাজেই ক্লাসটেস্ট পরে থাকল , নির্দ্বিধায় ছুটে গেলাম শাহবাগে। জানালাম - "আমার মাটি আমার মা , এখানে ধর্মব্যবসা চলবে না। শিক্ষা আমার অধিকার , শফি তুই কে তা কেড়ে নেয়ার ?" ধর্মব্যবসা , নারী অবমাননার বিরুদ্ধে সেদিন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর।

  • ১৭ ই সেপ্টেম্বর , ২০১৩

শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বিজয়টি এলো এই দিনে। এইদিন কাদের কসাই এর আপিলের রায় দেয়া হল - কাদের কসাই এর ফাসির রায় হল। যে কসাই এর হাতে বিজয় চিহ্ন সহ্য করতে না পেরে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের জন্ম হয়েছিল - সেই কাদের কসাই এর ফাসির রায় এলো অবশেষে। বাঙ্গালির জাগরণের কাছে পরাজিত হল রাজাকারের দম্ভ। কাদের কসাই এর ফাসির রায় প্রমান করে বাঙালি জেগে আছে , জেগে থাকবে। দেশবিরোধী কোন অপশক্তি এই ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে পার পেতে পারবে না। সেদিন অদ্ভুত একটা আনন্দ এসে ভর করেছিল আমার মধ্যে , অদ্ভুত রকম একটা ভালোবাসা কাজ করছিল । সকাল দশটা থেকে বিকাল পর্যন্ত ছিলাম শাহবাগে , বিজয় মিছিল করে বাড়ি ফিরেছিলাম। জীবনের শ্রেষ্ঠ বিজয় , শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের বিজয়। জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ - কাদের কসাই এর ফাসির আনন্দ। শ্রেষ্ঠ বিজয় মিছিল - কাদের কসাই এর ফাসির রায়ের আনন্দে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের বিজয় মিছিল। ইতিহাস গড়ল শাহবাগ , ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ।

  • ২৬ সেপ্টেম্বর , ২০১৩ 

এতদিন ধরে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন করছি । জামাত - শিবির - রাজাকাররা কি ছেড়ে কথা কইবে ? ছোট ভাইকে স্কুলে দিয়ে সি এন জি তে করে নিজের কলেজে আসছিলাম , মা সাথে ছিলেন। হাতিরঝিল দিয়ে যাওয়ার সময় কোথা থেকে এক গাড়ি এসে সি এন জি কে আঘাত করল। কপাল ফেটে রক্ত পরতে লাগলো আমার। মা তখন কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন । ঘটনাটা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সাধারন দুর্ঘটনা , কিন্তু সবকিছু যেমন সাজানো - গোছানো প্ল্যানিং করাভাবে ঘটছিল তাতে কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা ইচ্ছে করে করা হয়েছে। কে আর করবে? জামাত -শিবির ছাড়া আর কারো বাড়া ভাতে তো ছাই দেই নাই জীবনে। যাই হোক , সেদিন পুরো অনলাইন আমার জন্য যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন , যেভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আমি সত্যি এখনও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাইনা। এই ঘটনার পর মাথায় সেলাই নিয়ে যখন অনেক ব্যাথায় কাদতাম তখন মনে মনে ভাবতাম এই প্রত্যেকটা কষ্টের প্রতিশোধ নেব । বাংলার মাটিতে রাজাকারের ফাঁসি হবেই।
  • ৩০ অক্টোবর , ২০১৩

আমার কাছে শাহবাগে সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটি হল এই অক্টোবরের ত্রিশ তারিখ। এদিন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালাল ভাইয়া , রাজু আঙ্কেল ,হেলাল আঙ্কেল , রঞ্জু আঙ্কেলরা আসেন , আমাদেরকে শোনান একাত্তরের রনাঙ্গনের সেই রক্তঝরা দিনগুলোর গল্প।  ক্যাপ্টেন হায়দার , মেজর খালেদ মোশাররফ - বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালাল ভাইয়ার বর্ণনায় তাঁরা যেন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠেন। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠতে থাকে একাত্তর , গ্রেনেড বুকে বেধে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবরুদ্ধ ঢাকায় প্রবেশ করে অপারেশন করা একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা , মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর অবর্ণনীয় অত্যাচার । নিজামি - মুজাহিদ - কাদের কসাই দের অত্যাচারের বর্ণনা শুনি প্রত্যক্ষদর্শী বিচ্ছু জালাল ভাইয়ার কাছ থেকে। নিজামি - মুজাহিদ দের সেই অত্যাচারের চিহ্ন আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন একাত্তরের সেই কিশোর গেরিলা বিচ্ছু জালাল ভাইয়া।

  • ৩ নভেম্বর , ২০১৩ 

এর মধ্যেই আরেক রাজাকার আব্দুল আলিমের রায় হয়েছে , ফাসির রায় হয়নি - হয়েছে যাবজ্জীবন। প্রতিবাদে জেগে উঠেছে শাহবাগ। সবকিছুর উপর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক প্রাপ্তি তো আছেই  - রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ। রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ফলাফল হিসেবে ফাসির রায় আসতেই হবে - বাঙালি হার মানতে জানে না। এরপর ২ নভেম্বর , ২০১৩ থেকে আবার জেগে ওঠে শাহবাগ। পরপর দুইদিন অবস্থান চলতে থাকে। চৌধুরী মইনুদ্দিন আর আশরাফুজ্জামান - বিদেশে পলাতক দুই আলবদর নেতার ফাসির রায় নিয়ে ঘরে ফিরি আমরা।

আজ ৫ নভেম্বর , ২০১৩ । আমাদের প্রাণের শাহবাগ আন্দোলন আজ পার করেছে নয়টি মাস। নয় মাস ধরে এক ই আন্দোলন , এক ই দাবি - রাজাকারের ফাসি , এক ই প্রতিপক্ষ - সেই একাত্তরের পরাজিত শক্তি। আজকে আমি গর্বভরে বলতে পারি ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলন সম্পূর্ণ সফল একটা আন্দোলন জানি , আমাদের সব দাবি এখনও পূরণ হয়নি। একটা রাজাকারেরও এখনও ফাসি কার্যকর হয়নি। কিন্তু আমাদের সফলতা টা কোথায় জানেন ? শাহবাগের মূল সফলতা হল একটা প্রজন্মের জাগরন। শাহবাগের সফলতা হল সেই মেয়েটি যে হুইলচেয়ারে করে শাহবাগের মিছিলে ছুটে যায়। শাহবাগের সফলতা হল সেই মেয়েটি যে প্রেমিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা স্লোগানে অটল থাকে। রাজাকারের ফাসি কার্যকরের ক্ষমতা তো আমাদের হাতে নেই , শাহবাগের জনতার হাতে নেই। যে ক্ষমতা আছে তা হল সারা বাংলার প্রতিটা আনাচে - কানাচে মানুষকে জাগিয়ে তোলা রাজাকারের ফাসির দাবিতে।  আর সেদিক থেকে শাহবাগ সম্পূর্ণ সফল। এক একজন কিশোর - কিশোরী যখন সব বাধা -শৃঙ্খল ভেঙ্গে প্রজন্ম চত্বরে এসে ঘোষণা করে - "ক তে কাদের মোল্লা , তুই রাজাকার , তুই রাজাকার।" - ঠিক তখনই রাজাকারদের পরাজয় ঘণ্টা বেজে যায়। বাংলার মাটিতে রাজাকারদের পরাজয়ের ঘোষণা দেয়া হয়ে যায়। লাখো জনতার কণ্ঠে সমুদ্রের গর্জনের মত সেই দুর্জয় স্লোগান ই রাজাকারদের পরাজয় ঘোষণা।

জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় শহীদজননী , জয় গণজাগরণ মঞ্চ। জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন