শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

একাত্তরের চিঠি - ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী

'একাত্তরের চিঠি'র প্রচ্ছদে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রায় মলিন হয়ে আসা চিঠির মাঝে জ্বলজ্বলে অক্ষরে এক একটি বাংলা অক্ষর , আর সেই চিঠির ওপর টকটকে লাল রক্ত। এই চিঠিরা ইতিহাস , ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি, অসঙ্খ্য মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি। ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে আসে আরেক ইতিহাস - রনাঙ্গনের নানা ছোট - বড় স্মৃতি , কিংবা মা এর কাছে আকুল আবেদন -"মা , মাগো। দুটি পায়ে পড়ি মা। তোমার ছেলে ও মেয়েকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে... ঘরে আটকে রেখ না। ছেড়ে দাও স্বাধীনতার উত্তপ্ত রক্তপথে। শহীদ হয়ে অমর হব , গাজী হয়ে তোমারই কোলে ফিরে আসব মা। মাগো, জয়ী আমরা হবই। দোয়া রেখ। জয় বাংলা।" এই ইতিহাসকে বুকে নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি , এই রক্তভেজা ইতিহাসের জন্যই আমরা নিজেদেরকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি... মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি...। মোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি...।


তারিখঃ ৪ অক্টোবর , ১৯৭১

মাগো ,

সবেমাত্র রণাঙ্গন থেকে ফিরে এসে শিবিরে বিশ্রাম নিচ্ছি। একটা বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি। মনটা তাই বেশ উৎফুল্ল। হটাত মনে পরল তোমাকে । বাড়ি থেকে আসার পর এই প্রথম তোমাকে লিখছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তোমায় লিখতে পারিনি। বাঙ্কারে বসে আছি। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দ মিলে একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে।

মাগো, আজ মনে পরছে বিদায় নেবার বেলায় তোমার করুন হাসিমুখ। সাদা ধব্ধবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছিল তোমাকে। সেদিন পূর্ব দিগন্তের সূর্যটা বেশ লাল মনে হয়েছিল। আমার কি মনে হচ্ছিল জানো মা? অসংখ্য বাঙ্গালির রক্তে রঞ্জিত ঐ লাল সূর্যটা। ওর প্রতিটি কিরনচ্ছটা পৃথিবীর বুকে জন্ম দিয়েছে অগ্নি - শপথে বলীয়ান, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত এক একটি বাঙালি সন্তান। মাগো, তোমার কোলে জন্ম নিয়ে আমি ধন্য। শহীদের রক্তরাঙ্গা পথে তোমার আদুরে ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছ। ক্ষনিকের জন্য তোমার বুক কাঁপেনি, স্নেহের বন্ধন , দেশমাতৃকার ডাক উপেক্ষা করতে পারোনি। মা , তুমি শুনে খুশি হবে যে তোমারই মত অসঙ্খ্য জননী তাদের স্নেহ - ভালোবাসার ধন - পুত্র -স্বামী - আত্মীয় সর্বস্ব হারিয়েও শোকে মুহ্যমান হয়নি - বরং ইস্পাতকঠিন মনোবলে অগ্নি শপথে বলীয়ান।

মাগো , বাংলার প্রতিটা জননী কি তাদের সন্তানদের দেশের জন্য দান করতে পারেনা ? পারেনা মা - বোনেরা ভাইয়েদের পাশে এসে দাঁড়াতে ? তুমিই তো একদিন বলেছিলে - সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন এদেশের শিশুরা মা -বাবার কাছে বিস্কুট - চকলেট না চেয়ে চাইবে পিস্তল - রিভলবার। সেদিনের আশায় পথ চেয়ে আছে বাংলার প্রতিটি সন্তান - যেদিন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রতিফলিত হবে , অধিকারবঞ্চিত , শোষিত, নিপীড়িত, বুভুক্ষু সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা - আকাঙ্ক্ষা। যে মনোবল নিয়ে প্রথম তোমার থেকে বিদায় নিয়েছিলাম , তা আজ শতগুন বেড়ে গেছে। শুধু আমার নয় , প্রতিটা বাঙালি আজ আঘাত হানছে মাতোয়ারা। তাইতো বাংলার আনাচে - কানাচে এক মহাশক্তিতে বলীয়ান তোমার অবুঝ শিশুগুলোই আজ হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হেনেছে , পান করেছে হানাদার পশুদের তাজা রক্ত। ওরা মানুষ হত্যা করেছে , আর আমরা পশু হত্যা করছি।

মা , মাগো। দুটি পায়ে পড়ি মা। তোমার ছেলে ও মেয়েকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঘরে আটকে রেখ না। ছেড়ে দাও স্বাধীনতার উত্তপ্ত রক্তপথে। শহীদ হয়ে অমর হব , গাজী হয়ে তোমারই কোলে ফিরে আসব মা। মাগো, জয়ী আমরা হবই। দোয়া রেখ। জয় বাংলা।

তোমারই
দুলাল

ফুলবাড়িয়ার সম্মুখসমরে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা দুলাল। এরপর তিনি মারা যান , তাঁর মত আরও ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে প্লাবিত বাংলার মাটি। এই বাংলার প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে শহীদের রক্ত , বীরাঙ্গনা মাএর কান্না। কথা দিচ্ছি মা , কথা দিচ্ছি বাবা - তোমাদের রক্তের বদলা না নেয়া পর্যন্ত আমরাও ঘরে ফিরব না ...। তোমাদের খুনিদের , ধর্ষকদের ফাসি না হওয়া পর্যন্ত আমরাও ঘরে ফিরব না। বাংলা মা , আমরা তোমারই সন্তান। বারবার মরে বারবার ফিরে আসার জন্যই আমাদের জন্ম। আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত , এই রক্ত কোনোদিনও আপোষনামা লেখে না ... এই রক্ত কোনোদিনও পরাজয় মানে না।

জয় বাংলা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন