রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

আমি দেখিনি একাত্তর দেখেছি ঐ শাহবাগ , নবীনের জাগরণে বাংলাদেশ হতবাক !

৫ ফেব্রুয়ারি রাত । কিছুদিন আগেই বাচ্চু রাজাকারের রায় হয়েছে ফাঁসির  । বাংলাদেশের ইতিহাসে ৪২ বছর পর হলেও কোন রাজাকার কে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে । খবর টা নিয়ে খুব ই খুশি ছিলাম । ঐদিন কাদের কসাই এর রায় দেয়ার কথা ছিল , অপেক্ষা করছিলাম । বই পড়ছিলাম , কিন্তু পড়ায় মন ছিল না । মন ছিল কখন রায় আসবে সেই দিকে । হঠাৎ করে শুনি -একি সর্বনাশ , কাদের কসাই এর ফাঁসির রায় হয়নি , হয়েছে যাবজ্জীবন । কি করব , কি করা উচিত... কিছু বুঝি নি , শুধু প্রচণ্ড কষ্ট লাগছিল ।
তখন ও অনলাইন জগতের সাথে আমার তেমন পরিচয় নেই । ফেসবুক একাউন্ট ছিল , সেটাতে বসা হত মাসে একবার কি দুইবার । বলতে গেলে অনলাইন এর প্রতি তেমন ইন্টারেস্ট ছিল না । মনে আছে সেদিন যেরকম কষ্ট লাগছিল , নিজের জীবনের  কোন ব্যাপার নিয়েও মনে হয় কখনও এমন লাগে নাই - যেমন টা কাদের কসাই এর ফাঁসির রায় না হওয়াতে লেগেছিল । এরপর শুনলাম শাহবাগে সাধারণ মানুষ সমবেত হয়ে এই রায় এর প্রতিবাদ করছে । বুক টা গর্বে ভরে উঠল । মা কে রাজি করালাম অতি কষ্টে আমাকে শাহবাগ নিয়ে যাওয়ার জন্য । একদিন বাবা কে না বলে আমি আর মা যাই শাহবাগে । সকালে ১১ টার দিকে গিয়েছিলাম , বাসায় আসি বিকালে ৪ টায় - বাবা অফিস থেকে চলে আসবে , তা না হলে আর ও অনেকক্ষণ থাকার ইচ্ছা ছিল । মনে আছে বাসায় এসে মার সাথে অনেক রাগারাগি করেছিলাম আমাকে এত তাড়াতাড়ি নিয়ে আসল কেন সেটা নিয়ে । সেদিন ই বুঝলাম ,শাহবাগ কে ভালোবেসে ফেলেছি । বার বার আমাকে এরপর থেকে টেনে নিয়েছে শাহবাগ । সেদিন বাসায় এসে আমার এককালীন বেষ্ট ফ্রেন্ড কে ফোন করে কথা গুলো জানাই । দুইজন মিলে প্ল্যান করি যে কলেজ থেকে সবাই মিলে শাহবাগে যাব । সেইমত প্ল্যান চলতে থাকে । কখনো ভাবি নি এই কাজের জন্য শাস্তি হবে বা এই কাজ টা কেউ খারাপ চোখে দেখবে । আমার জীবনের কোন কিছুর জন্য যদি আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব করি তাহলে সেটা হল শাহবাগে যাওয়ার জন্য শাস্তি পাওয়া । যাই হোক , এই ঘটনার পর আর ও বেশি করে ভালবাসতে শুরু করি শাহবাগ কে । কোন কাজে বাধা দিলে সেই কাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ে , আমি তো তার ব্যাতিক্রম না । এর মধ্যে পেপার এ দেখি "ফেসবুক থেকে রাজপথে" নামক একটা কলাম । তখন বুঝতে পারি , প্রতিদিন বাবার চোখ এড়িয়ে শাহবাগে যাওয়া যেহেতু সম্ভব না , ফেসবুক এ এই ব্যাপার নিয়ে একটিভ থাকি , কিছুটা হলেও তো নিজেকে সান্তনা দিতে পারব । এরপর টেস্ট পেপার পড়ছি , উইকিপিডিয়া দেখে একটা জিনিস বুঝার চেষ্টা করছি -এসব এর আড়ালে চলতে থাকে আমার ব্লগিং -ফেসবুকিং । পরিচয় হয় অনেক মানুষের সাথে । তবে শাহবাগে যেতে পারছি না বলে যে অপরাধবোধ আমার মধ্যে কাজ করছিল তা থেকে আমাকে মুক্তি দেন ‎Vimpal Singha ভাইয়া।যেটা পারছি না সেটার জন্য দুঃখ না করে যেটা পারছি সেটা ই মন দিয়ে করতে আমাকে উৎসাহ দেন তিনি । এরপর পরিচয় হয় শামীম আরা নীপা আপুর সাথে । শহীদ রুমী স্কোয়াডের অনশনে ছিলেন আপু , সত্যি কথা হল আমার খুব গর্ব হচ্ছিল এই অনশনকারী আপু - ভাইয়াদের নিয়ে। এই ব্যাপারে কথা বলতে বলতেই নিপা আপুর সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায় ।

ততদিনে আমার আগের আপন মানুষগুলো অধিকাংশই দূরে সরে গেছে । প্রথম দিকে Faria Soroni Vasha এর কাছ থেকে কিছুটা সমর্থন পাই , কিন্তু তখন বুঝতে পারি নি এসব শুধু আমাকে ব্যাবহার করার  জন্য ওর একটা কৌশল ছিল।ওর প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার পর জানতে পারি ওর ভাই শিবির এর কর্মী।কিছুটা আশ্চর্য হলেও ওর সাথে সসম্পর্ক নষ্ট করিনি তখনও - কারণ , ওকে অনেক বেশি বিশ্বাস করতাম। হেফাজতের বিরাট গরু - ছাগলের হাট এ গিয়ে ওর ভাই মারা যাওয়ার পর ও যখন আমাকে বলে ওর ভাই কোনো দলের কেউ ছিল না , সরলমনে ওর কথা বিশ্বাস করি - কারণ ওকে অনেক অনেক বেশি বিশ্বাস করতাম আমি । এরপর ওর ভাইয়ের শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আমি পাই ওর ভাই এর নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ খুঁজতে গিয়েই। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে আমি বুঝতে পারি ওকে আর ঠিক পথে ফেরানো সম্ভব না । তাই আমাকে ও শাহবাগ কিংবা ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব যে কোনো একটা রাখতে বললে নির্দ্বিধায় শাহবাগ কে বেছে নেই । আর এর সাথে সাথে শুরু হয় আমার এককালীন বেস্ট ফ্রেন্ড কর্তৃক আমার নামে আমার চারপাশে নোংরা , মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো । আর অন্য মেয়েরা যখন ঈদের ড্রেস , হিন্দি সিরিয়াল ইত্যাদির চিন্তায় , আমি তখন সাঈদির রায় , কাদের কসাই এর রায় , শাহবাগ এসবের চিন্তায় । কাজেই সঙ্গত কারণেই আশেপাশের সবাই দূরে সরে যেতে শুরু করে আমার থেকে। ‎Mridula Amatun , Eshita Julia আমার এ দুইজন বান্ধবী তখন আমাকে সমর্থন করতো এবং এখনও করে । তোরা অন্য কলেজে কেন, এক কলেজে পড়লেই তো আমার আর এতটা একা থাকা লাগতো না কলেজে।

এরপর অনলাইনে শুরু হয় ছাগুদের স্ট্যাটাস খাওয়াখাওয়ি। ওগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়  Abir  এর সাথে । আবীর এড করে নেয় ক্র্যাক প্লাটুন গ্রুপে আর সেখানেই পরিচয় হয় নুসরাত জাহান আপু, মহাজাগতিক মন , পাগলা ঘন্টা , Riaj Sohel , Zonab  Shahadat Russel , Rakhal Beduin ,  একজন নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক , ‎Amit Iffat ভাই এর সাথে । আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যেটা - পরিচিত হই বীর মুক্তিযোদ্ধা Saif  Raju আঙ্কেল এর সাথে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এত কাছ থেকে দেখার , তাঁর সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হবে কখনো ভাবিনি এর আগে ।আঙ্কেল আমাদের সবার অভিভাবক , আমাদের সবার শ্রদ্ধার একজন মানুষ । তারপরও আমাদের সবার সাথে তিনি এত সুন্দরভাবে মিশে গেছেন , এত সহজভাবে সবাইকে আপন করে নেন যার কোন তুলনা নেই । প্রথম যেদিন সবার সাথে দেখা হয়েছিল , সেদিন প্রথমে খুব বেশি কথা বলতে পারছিলাম না আমি কারো সাথেই। আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব হল , লিখতে গেলে একটার পর একটা লাইন মাথায় আসতেই থাকবে , কিন্তু কথা বলতে গেলে আর কথা খুঁজে পাই না । কাজেই প্রথমে খুব বেশি স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারছিলাম না । নিজের মধ্যে থেকে অনেক চেষ্টা করছিলাম সবার সাথে সহজ হতে , কিন্তু নতুন মানুষ সবাই , আগে অনলাইন এ সবার সাথে পরিচয় থাকলেও বাস্তব জীবনে সেদিন ই প্রথম দেখা । কিন্তু আঙ্কেল এসে আমাকে কথা বলতে বাধ্য করলেন ইভেন্ট নিয়ে , সেই সাথে আমার বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল । এরপর সবার সাথে সহজ হতে আর সময় লাগে নি । আঙ্কেল , আপনার এখন অবসর নেয়ার কথা , ঘরে বসে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর কথা - কিন্তু আপনাদের মত প্রকৃত বীরেরা যেন ঘরে থাকার জন্য জন্মান নি , আমাদের বন্ধু হয়ে , অভিভাবক হয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সব সময় । আঙ্কেল আমি আপনার মত একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি ,একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সান্নিধ্য পেয়েছি , আমার সত্যি জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই । আপনি আমাদের এত ভালবাসেন বলেই আমরাও সুযোগ পাই একজন বীর  মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলার , হাত মেলানোর , আলোচনা করার - একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে কিছু শেখার । আমি জানি আঙ্কেল আমি এর যোগ্য না , তারপরও একটা প্রার্থনাই করি , আমি সারাজীবন আপনার স্নেহধন্য হয়ে থাকতে চাই - আমার  সত্যি আর কিছু চাওয়ার নেই জীবনের কাছ থেকে ।


নানা প্রতিবাদ , মিছিল - মিটিং , অনলাইনে- অফলাইনে রাজাকার, জামাত - শিবিরের বিরুদ্ধে তর্ক - বিতর্ক  আর প্রতিদিনের ছোট - বড় নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শাহবাগকে ভালোবেসে ফেলেছি  অনেক বেশি । কাছের অনেক মানুষ দূরে সরে গিয়েছে , আরও যাবে তাও জানি - কিন্তু আমার  ভালোবাসার শাহবাগ ,গনজাগরণ মঞ্চ , যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দবি থেকে আমি সরব না । "জয় বাংলা" স্লোগানটা আমার কাছে আমার জীবনের চেয়েও আপন । কন্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি  , বুকের মাঝে আমার বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা আর প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত -  "আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালোবাসি " কে বাঁচিয়ে রাখব সারাজীবন।  আমার সোনার বাংলা , তুই আমার অনেক বেশি আপন ,যে কোন কিছুর চেয়ে আপন -আমি তোকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি বাংলা মা । ভালোবাসি তোর প্রাণের স্পন্দন কে , ভালোবাসি "জয় বাংলা " কে ।
"মনে আছে ভুলি নাই
রাজাকারের ফাঁসি চাই
জামাত - শিবির নিষিদ্ধ চাই
আর কোন দাবি নাই ।"

জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় তারুন্য , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার

1 টি মন্তব্য: