মুক্তিযুদ্ধের পর , ১৯৭১ এ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ৪২ বছর পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আবার শুনল বাংলার দামাল ছেলেদের গর্জন । উদ্যত মুষ্টিবদ্ধ হাতে বাংলার জনতা শাহবাগে সমবেত হয়ে ঘোষণা দেয় তাদের আর কোন দাবি নেই , তারা শুধুই রাজাকারের ফাঁসি চায় । পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধ মা - বাবা , কোন বাঙালি ই নিজের প্রানের দাবিকে অস্বীকার করতে পারেনি । 'শাহবাগ' -শুধু একটি জায়গার নাম নয় , আজ এটি একটি জাগরনের নাম , একটি ভালোবাসার নাম , একটি সদ্য ফোটা গোলাপের নাম ।
মা জাহানারা ইমাম থেকে শুরু করে আজ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে যে বিশাল গনজাগরন , সে সব কিছুকে ধারন করে জেগে থাকা একটি নাম - শাহবাগ। শাহবাগের গনজাগরন মঞ্চ শুধু একটি মঞ্চই নয় , শাহবাগ গনজাগরন মঞ্চ কোটি কোটি বাঙ্গালির হৃদয়ের স্পন্দনের নাম । এই মঞ্চ কোন কাঠের মঞ্চ নয় যে ভেঙ্গে যাবে , এই মঞ্চের অবস্থান দেশের প্রতিটা তরুন প্রাণে , যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে জাগ্রত প্রতি অন্তরে। এই ভালোবাসা আমাকে কতটা পরিবর্তন করে দিয়েছে তা আমি প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি । আমি পারি না শাহবাগের সাথে অন্য কিছুর তুলনা করতে , অন্য কিছুর জন্য , কারো জন্য আমি শাহবাগের আন্দোলনের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ করতে পারি না - সে আমার বাবাই হোক আর বেস্ট ফ্রেন্ড ই হোক। আমার অবাক লাগে - যে বান্ধবী টি ছিল আমার সবচেয়ে আপন , কলেজে প্রতিটা কাজে আমার সাথে যে বান্ধবীটিকে দেখা যেত , তার হেফাজতি মানসিকতার কারনে আজ তাকে আমি অনায়াসে দূরে সরিয়ে দিতে পারি । সে শাহবাগ আর তার মাঝে একটা পহন্দ করতে বললে অনায়াসে শাহবাগ কেই বেছে নিতে পারি। হয়ত আজও কলেজে গেলে একা লাগে , হয়ত আজও প্রিয় বান্ধবীর সাথে কাটানো সুন্দর সময় গুলো অনেক মিস করি - কিন্তু তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি ভালোবাসি শাহবাগ কে , জয় বাংলা কে । আমার বাংলাদেশ টা কে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি ,বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি প্রাণের চেয়েও বেশি -এবং আমি জানি এই ভালোবাসা মিথ্যা নয় , অলীক নয় - সত্য , চিরন্তন সত্য । এই ভালোবাসার চেয়ে বাস্তব কোন ভালোবাসা আছে বলে আমি জানি না...তাই চিরন্তন সত্য এই ভালোবাসার জন্য অস্বীকার করি সব বন্ধন - খুঁজে বেড়াই আমার ভালোবাসার বাংলাদেশ কে , যেই বাংলাদেশ এ রাজাকার- আলবদরের কোন ঠাই নাই । খুঁজে বেড়াই সেই বাঙালি কে যারা ১৯৭১ এ ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা ,যারা ১৯৫২ তে ছিনিয়ে এনেছিল মাতৃভাষার অধিকার । এইত আমার ভালোবাসার বাঙালি যারা জন্মযোদ্ধা , যারা যে কোন প্রতিকূলতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে , ঝড় , বন্যা , সাভার ট্র্যাজেডি -কোন কিছুই যাদের টলাতে পারে না ... সেই বাঙালি কি হারতে পারে ? সেই বাঙালি কি স্বাধীন দেশ এ রাজাকারের গাড়িতে ৩০ লাখ শহীদ এর রক্তে ভেজা পতাকা সহ্য করতে পারে ? কখনোই না ।আমার ভালোবাসার বাঙালি নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে রাজাকারের ফাঁসির জন্য লড়ে যেতে পারে । দেশ এর জন্য ত্যাগ করতে পারে নিজের জীবন পর্যন্ত - তার প্রমান ১৯৫২ এর ভাষা শহীদেরা , তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু সহ জাতীয় চার নেতা , তার প্রমাণ ১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধারা , তার প্রমাণ রাজাকারের ফাঁসির দাবি নিয়ে অনড় আমার সহযোদ্ধারা। তার প্রমান দীপ , রাজীব , তন্ময় , তার প্রমাণ ৫২, ৬২, ৬৯,৭১ এর শহীদেরা ।
“৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ বীরাঙ্গনা ” কথাটিকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। নিজেকে কল্পনা করুন তো সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার জায়গায় , সহযোদ্ধার মৃত্যুস্মৃতিটি আজও যাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই বীরাঙ্গনা বোনের জায়গায় নিজেকে চিন্তা করুন – মৃত্যুর আগে নিজের রক্ত দিয়ে যিনি লিখে গিয়েছিলেন – “জয় বাংলা”। কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অগণিত নির্যাতিত তরুণ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কিংবা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে, নাম – না – জানা অসংখ্য গণকবরে অজ্ঞাতনামা লক্ষ লক্ষ শহীদের লাশের মাঝে নিজেকে কল্পনা করুন। এই শহীদেরা , বীরাঙ্গনারা , বীর মুক্তিযোদ্ধারা কারা ? আমাদেরই কারো মা – বাবা-ভাই – বোন কিংবা অতি প্রিয় আপনজন। নিজের সদ্যজাত শিশু সন্তানটিকে কল্পনা করুন তো পাকিস্তানিদের বেয়নেট দিয়ে চেরা অবস্থায়। “৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ বীরাঙ্গনা ” বলতে কি বোঝায় , উত্তর পেয়ে যাবেন।আমাদের মনে রাখতে হবে , “এ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। রাজাকাররাও এ প্রজন্মের যুদ্ধ দেখেনি। দেখিয়ে দেওয়ার এখনই সময়।” আমরা বাঙালি , শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে হলেও আমরা শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি। বাংলা মায়ের বুকে শত্রুর দাপট যে আমরা মেনে নেইনা তার প্রমাণ ১৯৫২ , ১৯৬২ , ১৯৬৬ , ১৯৬৯ , ১৯৭১। ২০১৩ তে আবারও যদি সেই পুরনো হায়েনা আমার বাংলা মাকে ধর্ষণ করতে চায় তাহলে বাংলা মাকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে । আজ আর মহাত্মা গান্ধী নয় , দরকার বঙ্গবন্ধু। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ নয় , দরকার যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার আহ্বান। বঙ্গবন্ধুকে এখন অনেক বেশি দরকার – কিন্তু আমরা একটি বেঈমান , অকৃতজ্ঞ জাতি । তাই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধাণ কান্ডারী বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি অনেক আগেই। বাঙালির জীবনে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর নেই। বঙ্গবন্ধুকে কিংবা ৩০ লাখ শহীদকে কাউকেই আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। পারব না সহযোদ্ধার স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধার অশ্রু মুছিয়ে দিতে । বীরাঙ্গনা মা এর অন্তরের কান্না আমরা কোনোদিন থামাতে পারব না। কিন্তু আমরা লড়তে পারব , স্বাধীন বাংলার মাটিতে রাজাকারের আস্ফালন থামাতে পারব আমাদের লড়াই দিয়ে। এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই , এ লড়াই যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলা গড়ার লড়াই। আমরা আপোষনামা লিখতে জানি না , লড়াই করে বাঁচতে চাই । মনে রাখতে হবে , এ লড়াই এর জন্য অস্ত্রের আগে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল , প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি এক থাকা । আমাদের দরকার নেই তো জামাত - শিবির এর মত নৃশংস হওয়া , শুধু প্রয়োজন এক থাকা - আমরা এক হয়ে শাহবাগ থেকে হেফাজতকে তাড়িয়েছিলাম , মনে আছে ? আমরা চাইলে সব ই সম্ভব । আজকে আমরা এক হয়ে তুলছি যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবি , জামাত - শিবির নিষিদ্ধের দাবি । এ দাবি আদায়ের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি আমরা- আন্দোলন পুরোপুরি সফল সেদিনই হবে যেদিন বাংলার প্রতি ঘরের প্রতিটা মানুষ অন্তর থেকে জামাত - শিবির কে ঘৃণা করবে । সেদিন আর আইনের দরকার নেই, জামাত - শিবির এমনিতেই নিসিদ্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশে । যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবি আমরা জানাচ্ছি , ফাসি হওয়ার আগ পর্যন্ত জানিয়ে যাব কিন্তু ফাসি দেয়া তো আমাদের সাধারন জনগনের পক্ষে সম্ভব না (এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বাস্তব ট্র্যাজেডি )কিন্তু সারা বাংলার প্রতিটা অন্তর যাতে জামাত - শিবির কে ঘৃণা করে সে লক্ষ্য অর্জনে আসুন নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাই। প্রদীপটা জ্বলছে ,জ্বলুক , একে জ্বালিয়ে রাখুন । একে নিভিয়ে দিবেন না , নিভতে দিবেন না।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলন এর মধ্যে অতিক্রম করেছে সাতটি মাস । যে কোন ভাল কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই , শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আন্দোলন টা শুরুর পর থেকেই এর পক্ষে - বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত থাকলেও শাহবাগ আন্দোলন এগিয়ে গেছে তার নিজস্ব গতিতে । দেশের প্রতি প্রান্তের প্রতিটা দেশপ্রেমিক তরুন কে তাদের প্রানের স্পন্দনের টানে এক করেছে শাহবাগ । শাহবাগের টানে সেই তরুনরাই ঘর ছাড়ে যারা 'আমার বন্ধু রাশেদ' দেখে চোখের পানিতে বুক ভাসায় , "একাত্তরের দিনগুলি " পড়ে শহীদ রুমী হওয়ার স্বপ্ন দেখে , "মা" পড়ে শহীদ রুমী - বদি - আজাদ - আলতাফ মাহমুদ - জুয়েল এর জন্য কাঁদে । এই তরুণেরা ঐশীর মত প্রতি সপ্তাহে হাত খরচের জন্য এক লাখ টাকা পায় না , বরং এরা সেই তরুন যারা টিফিন এর টাকা জমায় জাফর ইকবাল স্যার এর "মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস " কেনার জন্য । শাহবাগের এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় , মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসে বড় হতে চায় - সেজন্য নিজেদের অনেক সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য কে বিসর্জন দিতে এরা রাজি। কোটি প্রানের জাগরনের এই শাহবাগ এনে দিয়েছে সাইদি , কামরুজ্জামান , মুজাহিদ কুলাঙ্গার এর ফাঁসির রায় । লাকি আপু ,শাম্মী আপুর সাথে লক্ষ তরুনের উচ্চকিত কন্ঠে "ক তে কাদের মোল্লা , তুই রাজাকার , তুই রাজাকার " স্লোগান বাধ্য করেছে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র পক্ষের আপিল এর সুযোগ তৈরি করতে । গনমানুষের এই জাগরন বাধ্য করেছে গোলাম আজম - সাইদি - মুজাহিদ - কাদের কসাই - সাকা - কামরুজ্জামান কে বিচারের মুখোমুখি করতে । শাহবাগ আমাকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তেজে জ্বলতে শিখিয়েছে দাবি আদায়ের পথে । শাহবাগ আমাকে বিদ্রোহী কবির বাণীর মত বিদ্রোহী ভাষা শিখিয়েছে । শাহবাগ আমাকে মানুষের তরে রক্ত দিতে শিখিয়েছে । শাহবাগে আমাকে দাবি আদায়ের পথে রাস্তায় ঘুমাতে , প্রেসক্লাবের সামনে রাতভোর হাঁটতে শিখিয়েছে । বন্ধু আর দেশ এর মধ্যে বন্ধুকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে দেশ কে আপন করে নিতে আমায় শিখিয়েছে শাহবাগ । বাবার বাধার মুখে কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমায় শিখিয়েছে শাহবাগ।এত কিছুর পরও কে বলবি শাহবাগ আন্দোলন ব্যার্থ ? কে বলবি আমার বাংলাদেশ কে দিয়ে কিছু হবে না ? আয় আমার সামনে এসে বল ।
সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই , শাহবাগ দেশের প্রতি প্রাণে যে জাগরন সৃষ্টি করেছে সেখানেই শাহবাগের মূল সার্থকতা। শাহবাগ যে সব বাঙালিকে এক সুতায় গেঁথে এক দাবিতে একাত্ম করতে পেরেছে সেখানেই শাহবাগের মূল সার্থকতা। যুদ্ধাপরাধী , জামাত- শিবিরের প্রকৃত রূপ যে বাংলার মানুষ চিনতে শিখেছে সেখানেই শাহবাগের সাফল্যটুকু। শাহবাগ পরিবারের প্রতিটা সদস্য আজ এক দাবির বন্ধনে একে অপরের সাথে একাত্ম। জনসমুদ্রের এ উত্তাল কলোরল আমি বলব সম্পূর্ণ সার্থক। শাহবাগের গনমানুষের হাতে যদি রাজাকারের ফাঁসির ভার থাকত , তাহলে আমরা অনেক আগেই বিজয় মিছিল করতে পারতাম রাজাকারের ফাঁসির আনন্দে। আমরা শাহবাগে তো অনেক আগেই কফিন রেডি করে রাজাকারের লাশ চেয়েছি। আর পরিবারের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়েটিকে উত্তাল স্লোগানমুখর সমাবেশের , মিছিলের অংশ করে নিয়ে তার কন্ঠে তার প্রাণের দাবি "রাজাকারের ফাঁসি চাই " , প্রাণের স্লোগান " জয় বাংলা " তুলে দেয়ার কৃতিত্ব শাহবাগের। আর এ নবচেতনার সাক্ষী হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে হৃদয়ে গেঁথে রাখা অমর স্লোগান গুলো। জেগে থাকবে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর , নব ইতিহাসের সাথী হয়ে।
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় তারুন্য , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।
মা জাহানারা ইমাম থেকে শুরু করে আজ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে যে বিশাল গনজাগরন , সে সব কিছুকে ধারন করে জেগে থাকা একটি নাম - শাহবাগ। শাহবাগের গনজাগরন মঞ্চ শুধু একটি মঞ্চই নয় , শাহবাগ গনজাগরন মঞ্চ কোটি কোটি বাঙ্গালির হৃদয়ের স্পন্দনের নাম । এই মঞ্চ কোন কাঠের মঞ্চ নয় যে ভেঙ্গে যাবে , এই মঞ্চের অবস্থান দেশের প্রতিটা তরুন প্রাণে , যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে জাগ্রত প্রতি অন্তরে। এই ভালোবাসা আমাকে কতটা পরিবর্তন করে দিয়েছে তা আমি প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি । আমি পারি না শাহবাগের সাথে অন্য কিছুর তুলনা করতে , অন্য কিছুর জন্য , কারো জন্য আমি শাহবাগের আন্দোলনের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ করতে পারি না - সে আমার বাবাই হোক আর বেস্ট ফ্রেন্ড ই হোক। আমার অবাক লাগে - যে বান্ধবী টি ছিল আমার সবচেয়ে আপন , কলেজে প্রতিটা কাজে আমার সাথে যে বান্ধবীটিকে দেখা যেত , তার হেফাজতি মানসিকতার কারনে আজ তাকে আমি অনায়াসে দূরে সরিয়ে দিতে পারি । সে শাহবাগ আর তার মাঝে একটা পহন্দ করতে বললে অনায়াসে শাহবাগ কেই বেছে নিতে পারি। হয়ত আজও কলেজে গেলে একা লাগে , হয়ত আজও প্রিয় বান্ধবীর সাথে কাটানো সুন্দর সময় গুলো অনেক মিস করি - কিন্তু তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি ভালোবাসি শাহবাগ কে , জয় বাংলা কে । আমার বাংলাদেশ টা কে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি ,বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি প্রাণের চেয়েও বেশি -এবং আমি জানি এই ভালোবাসা মিথ্যা নয় , অলীক নয় - সত্য , চিরন্তন সত্য । এই ভালোবাসার চেয়ে বাস্তব কোন ভালোবাসা আছে বলে আমি জানি না...তাই চিরন্তন সত্য এই ভালোবাসার জন্য অস্বীকার করি সব বন্ধন - খুঁজে বেড়াই আমার ভালোবাসার বাংলাদেশ কে , যেই বাংলাদেশ এ রাজাকার- আলবদরের কোন ঠাই নাই । খুঁজে বেড়াই সেই বাঙালি কে যারা ১৯৭১ এ ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা ,যারা ১৯৫২ তে ছিনিয়ে এনেছিল মাতৃভাষার অধিকার । এইত আমার ভালোবাসার বাঙালি যারা জন্মযোদ্ধা , যারা যে কোন প্রতিকূলতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে , ঝড় , বন্যা , সাভার ট্র্যাজেডি -কোন কিছুই যাদের টলাতে পারে না ... সেই বাঙালি কি হারতে পারে ? সেই বাঙালি কি স্বাধীন দেশ এ রাজাকারের গাড়িতে ৩০ লাখ শহীদ এর রক্তে ভেজা পতাকা সহ্য করতে পারে ? কখনোই না ।আমার ভালোবাসার বাঙালি নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে রাজাকারের ফাঁসির জন্য লড়ে যেতে পারে । দেশ এর জন্য ত্যাগ করতে পারে নিজের জীবন পর্যন্ত - তার প্রমান ১৯৫২ এর ভাষা শহীদেরা , তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু সহ জাতীয় চার নেতা , তার প্রমাণ ১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধারা , তার প্রমাণ রাজাকারের ফাঁসির দাবি নিয়ে অনড় আমার সহযোদ্ধারা। তার প্রমান দীপ , রাজীব , তন্ময় , তার প্রমাণ ৫২, ৬২, ৬৯,৭১ এর শহীদেরা ।
“৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ বীরাঙ্গনা ” কথাটিকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। নিজেকে কল্পনা করুন তো সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার জায়গায় , সহযোদ্ধার মৃত্যুস্মৃতিটি আজও যাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই বীরাঙ্গনা বোনের জায়গায় নিজেকে চিন্তা করুন – মৃত্যুর আগে নিজের রক্ত দিয়ে যিনি লিখে গিয়েছিলেন – “জয় বাংলা”। কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অগণিত নির্যাতিত তরুণ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কিংবা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে, নাম – না – জানা অসংখ্য গণকবরে অজ্ঞাতনামা লক্ষ লক্ষ শহীদের লাশের মাঝে নিজেকে কল্পনা করুন। এই শহীদেরা , বীরাঙ্গনারা , বীর মুক্তিযোদ্ধারা কারা ? আমাদেরই কারো মা – বাবা-ভাই – বোন কিংবা অতি প্রিয় আপনজন। নিজের সদ্যজাত শিশু সন্তানটিকে কল্পনা করুন তো পাকিস্তানিদের বেয়নেট দিয়ে চেরা অবস্থায়। “৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ বীরাঙ্গনা ” বলতে কি বোঝায় , উত্তর পেয়ে যাবেন।আমাদের মনে রাখতে হবে , “এ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। রাজাকাররাও এ প্রজন্মের যুদ্ধ দেখেনি। দেখিয়ে দেওয়ার এখনই সময়।” আমরা বাঙালি , শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে হলেও আমরা শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি। বাংলা মায়ের বুকে শত্রুর দাপট যে আমরা মেনে নেইনা তার প্রমাণ ১৯৫২ , ১৯৬২ , ১৯৬৬ , ১৯৬৯ , ১৯৭১। ২০১৩ তে আবারও যদি সেই পুরনো হায়েনা আমার বাংলা মাকে ধর্ষণ করতে চায় তাহলে বাংলা মাকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে । আজ আর মহাত্মা গান্ধী নয় , দরকার বঙ্গবন্ধু। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ নয় , দরকার যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার আহ্বান। বঙ্গবন্ধুকে এখন অনেক বেশি দরকার – কিন্তু আমরা একটি বেঈমান , অকৃতজ্ঞ জাতি । তাই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধাণ কান্ডারী বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি অনেক আগেই। বাঙালির জীবনে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর নেই। বঙ্গবন্ধুকে কিংবা ৩০ লাখ শহীদকে কাউকেই আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। পারব না সহযোদ্ধার স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধার অশ্রু মুছিয়ে দিতে । বীরাঙ্গনা মা এর অন্তরের কান্না আমরা কোনোদিন থামাতে পারব না। কিন্তু আমরা লড়তে পারব , স্বাধীন বাংলার মাটিতে রাজাকারের আস্ফালন থামাতে পারব আমাদের লড়াই দিয়ে। এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই , এ লড়াই যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলা গড়ার লড়াই। আমরা আপোষনামা লিখতে জানি না , লড়াই করে বাঁচতে চাই । মনে রাখতে হবে , এ লড়াই এর জন্য অস্ত্রের আগে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল , প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি এক থাকা । আমাদের দরকার নেই তো জামাত - শিবির এর মত নৃশংস হওয়া , শুধু প্রয়োজন এক থাকা - আমরা এক হয়ে শাহবাগ থেকে হেফাজতকে তাড়িয়েছিলাম , মনে আছে ? আমরা চাইলে সব ই সম্ভব । আজকে আমরা এক হয়ে তুলছি যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবি , জামাত - শিবির নিষিদ্ধের দাবি । এ দাবি আদায়ের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি আমরা- আন্দোলন পুরোপুরি সফল সেদিনই হবে যেদিন বাংলার প্রতি ঘরের প্রতিটা মানুষ অন্তর থেকে জামাত - শিবির কে ঘৃণা করবে । সেদিন আর আইনের দরকার নেই, জামাত - শিবির এমনিতেই নিসিদ্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশে । যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবি আমরা জানাচ্ছি , ফাসি হওয়ার আগ পর্যন্ত জানিয়ে যাব কিন্তু ফাসি দেয়া তো আমাদের সাধারন জনগনের পক্ষে সম্ভব না (এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বাস্তব ট্র্যাজেডি )কিন্তু সারা বাংলার প্রতিটা অন্তর যাতে জামাত - শিবির কে ঘৃণা করে সে লক্ষ্য অর্জনে আসুন নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাই। প্রদীপটা জ্বলছে ,জ্বলুক , একে জ্বালিয়ে রাখুন । একে নিভিয়ে দিবেন না , নিভতে দিবেন না।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলন এর মধ্যে অতিক্রম করেছে সাতটি মাস । যে কোন ভাল কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই , শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আন্দোলন টা শুরুর পর থেকেই এর পক্ষে - বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত থাকলেও শাহবাগ আন্দোলন এগিয়ে গেছে তার নিজস্ব গতিতে । দেশের প্রতি প্রান্তের প্রতিটা দেশপ্রেমিক তরুন কে তাদের প্রানের স্পন্দনের টানে এক করেছে শাহবাগ । শাহবাগের টানে সেই তরুনরাই ঘর ছাড়ে যারা 'আমার বন্ধু রাশেদ' দেখে চোখের পানিতে বুক ভাসায় , "একাত্তরের দিনগুলি " পড়ে শহীদ রুমী হওয়ার স্বপ্ন দেখে , "মা" পড়ে শহীদ রুমী - বদি - আজাদ - আলতাফ মাহমুদ - জুয়েল এর জন্য কাঁদে । এই তরুণেরা ঐশীর মত প্রতি সপ্তাহে হাত খরচের জন্য এক লাখ টাকা পায় না , বরং এরা সেই তরুন যারা টিফিন এর টাকা জমায় জাফর ইকবাল স্যার এর "মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস " কেনার জন্য । শাহবাগের এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় , মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসে বড় হতে চায় - সেজন্য নিজেদের অনেক সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য কে বিসর্জন দিতে এরা রাজি। কোটি প্রানের জাগরনের এই শাহবাগ এনে দিয়েছে সাইদি , কামরুজ্জামান , মুজাহিদ কুলাঙ্গার এর ফাঁসির রায় । লাকি আপু ,শাম্মী আপুর সাথে লক্ষ তরুনের উচ্চকিত কন্ঠে "ক তে কাদের মোল্লা , তুই রাজাকার , তুই রাজাকার " স্লোগান বাধ্য করেছে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র পক্ষের আপিল এর সুযোগ তৈরি করতে । গনমানুষের এই জাগরন বাধ্য করেছে গোলাম আজম - সাইদি - মুজাহিদ - কাদের কসাই - সাকা - কামরুজ্জামান কে বিচারের মুখোমুখি করতে । শাহবাগ আমাকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তেজে জ্বলতে শিখিয়েছে দাবি আদায়ের পথে । শাহবাগ আমাকে বিদ্রোহী কবির বাণীর মত বিদ্রোহী ভাষা শিখিয়েছে । শাহবাগ আমাকে মানুষের তরে রক্ত দিতে শিখিয়েছে । শাহবাগে আমাকে দাবি আদায়ের পথে রাস্তায় ঘুমাতে , প্রেসক্লাবের সামনে রাতভোর হাঁটতে শিখিয়েছে । বন্ধু আর দেশ এর মধ্যে বন্ধুকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে দেশ কে আপন করে নিতে আমায় শিখিয়েছে শাহবাগ । বাবার বাধার মুখে কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমায় শিখিয়েছে শাহবাগ।এত কিছুর পরও কে বলবি শাহবাগ আন্দোলন ব্যার্থ ? কে বলবি আমার বাংলাদেশ কে দিয়ে কিছু হবে না ? আয় আমার সামনে এসে বল ।
সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই , শাহবাগ দেশের প্রতি প্রাণে যে জাগরন সৃষ্টি করেছে সেখানেই শাহবাগের মূল সার্থকতা। শাহবাগ যে সব বাঙালিকে এক সুতায় গেঁথে এক দাবিতে একাত্ম করতে পেরেছে সেখানেই শাহবাগের মূল সার্থকতা। যুদ্ধাপরাধী , জামাত- শিবিরের প্রকৃত রূপ যে বাংলার মানুষ চিনতে শিখেছে সেখানেই শাহবাগের সাফল্যটুকু। শাহবাগ পরিবারের প্রতিটা সদস্য আজ এক দাবির বন্ধনে একে অপরের সাথে একাত্ম। জনসমুদ্রের এ উত্তাল কলোরল আমি বলব সম্পূর্ণ সার্থক। শাহবাগের গনমানুষের হাতে যদি রাজাকারের ফাঁসির ভার থাকত , তাহলে আমরা অনেক আগেই বিজয় মিছিল করতে পারতাম রাজাকারের ফাঁসির আনন্দে। আমরা শাহবাগে তো অনেক আগেই কফিন রেডি করে রাজাকারের লাশ চেয়েছি। আর পরিবারের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়েটিকে উত্তাল স্লোগানমুখর সমাবেশের , মিছিলের অংশ করে নিয়ে তার কন্ঠে তার প্রাণের দাবি "রাজাকারের ফাঁসি চাই " , প্রাণের স্লোগান " জয় বাংলা " তুলে দেয়ার কৃতিত্ব শাহবাগের। আর এ নবচেতনার সাক্ষী হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে হৃদয়ে গেঁথে রাখা অমর স্লোগান গুলো। জেগে থাকবে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর , নব ইতিহাসের সাথী হয়ে।
জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় তারুন্য , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন