রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জয় বাংলা , জয় হোক বাংলার , জয় হোক বাঙ্গালির

কলেজে আমার এক সময় খুব কাছের একজন বন্ধু ছিল - নাম ভাষা । কলেজের সবাই , এমন কি ব্যক্তিগত জীবনে কলেজের বাইরে যারা আমাকে চিনত সবাই জানত ভাষা আমার কেমন বন্ধু । ইন ফ্যাক্ট , কলেজের শিক্ষক রাও বলতেন - তোরা দুইটা তো সারাদিন ম্যগনেটের মত থাকিস ! আমরা তখন আসলেই একজন আরেকজনের খুব কাছের মানুষ ছিলাম। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগ গনজাগরন মঞ্চ নিয়ে আমাদের দুইজনের ধীরে ধীরে মতের অমিল হতে থাকে । তারপর শাহবাগে যাওয়ার জন্য আমাকে কলেজ থেকে সাময়িক ভাবে বহিষ্কৃত করা হয় - সেই থেকে সে ধীরে ধীরে দূরে সরতে থাকে আমার থেকে , আমি ভাবতাম যে এগুলো গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা । কিন্তু আসলেই যে ভাষা ধীরে ধীরে আমার বিপক্ষে চলে যাচ্ছিল সেটা তখন ক্ষুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ।
এরপর মাঝে মাঝেই তার সাথে কথা কাটাকাটি হত - আমি অনলাইনে গনজাগরন মঞ্চের পক্ষে লিখি এটা সে কিছুতেই মানতে পারত না । আমি তখন ও জানতাম না যে ভাষার ভাই শিবির কর্মী , তাই  ভাষাকে সঠিক পথে আনার আপ্রান চেষ্টা করতাম । ৫ ই মে ভাষার ভাই হেফাজতের বিশাল গরু - ছাগলের হাটে যায় , শুনেছি সে ওখানে মারা যায় । তখন আমাদের পরীক্ষা চলছিল কলেজে । ভাষা অনেক দিন কলেজে আসে নি তখন । আমার মনে আছে আমি কতোটা পাগলের মত হয়ে যেতাম সে সময় ফোনে ভাষার কান্না শুনে । ওর শিবির কর্মী ভাই কে আমি ঘৃণা করতাম , এখন ও করি , সারাজীবন করব - কিন্তু ওকে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করতাম । কারন , আমি সত্যি ওকে অনেক আপন ভাবতাম । এরপর ২৮ জুন - আমি , আমার সহযোদ্ধা আর ও কয়েকজন কে নিয়ে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবিতে মানব বন্ধনের ডাক দিলাম। এবার প্রকাশিত হল আমার প্রিয় বান্ধবীর আসল রুপ । তার এক কথা - রাজাকারের ফাসির দাবির সাথে আমি থাকলে সে আমার সাথে নেই। অনেক বুঝালাম , অনেক তর্ক - বিতর্ক করলাম , লাভ কিছুই হল না । শেষে ভাষা বলল হয় আমাকে গনজাগরন মঞ্চের সাথে থাকতে হবে নতুবা ভাষার সাথে । আমার মধ্যে সেদিন কি শক্তি এসে ভর করেছিল আমি নিজেও জানি না - আমি আমার সব চেয়ে প্রিয় বান্ধবীকে ত্যাগ করতে পারলাম নির্দ্বিধায় । সত্যি বলছি - আগে কোন কারনে আমাদের দুইজনের মধ্যে মনোমালিন্য হলেই আমার কান্না কেউ থামাতে পারত না , কিন্তু সেদিন আমাকে সেই ভাষাও কাঁদাতে পারে নি , আমার বিশ্বাস থেকে টলাতে পারে নি। আমার মনে হচ্ছিল , আমি তো কাদতে আসি নি , আমি তো ফাসির দাবি নিয়ে এসেছি , এতোটুকু যদি সহ্য করতে না পারব তাহলে কিসের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি আমি ? সেদিন বাসায় এসে আমার কাছে লেখা ভাষার প্রত্যেক টা চিঠি কুটি কুটি করে ছিঁড়েছিলাম - কারন একজন শিবির সমর্থকের সাথে একজন  মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষের কোন রকম যোগাযোগ থাকতে পারে না ।


ভালই ছিলাম , নিজের মত করে পড়াশুনা , আন্দোলন সব চালিয়ে নিচ্ছিলাম । বাবা জামাত সমর্থক - তাই শাহবাগ , গনজাগরন মঞ্চের প্রতি আমার ভালোবাসার কারনে এক সময় বাবার সাথেও সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়ে যায় । কতদিন যে আমার রুমের দরজা বাবা বন্ধ করে রেখেছে সারাদিন যাতে আ্মি শাহবাগে যেতে না পারি , আর আমি রুমে বসে চুপচাপ কেদেছি তার কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই । কত মার খেয়েছি বাবার কাছে আর কত অপমান সহ্য করেছি কলেজে তার ও কোন সীমা নেই । এ সব কিছু কিসের জন্য ? রাজাকারের ফাসি । সেই ফাসি কি হবে কিনা , কাদের কসাই এর আপিলের রায় টা অন্তত ফাসির হবে কিনা - তার ও কোন খোঁজ নেই । মার কাছ থেকে মৌন সমর্থন সব সময় পেয়েছি , মা একবার মিছিলে আমার সাথে এসে দাঁড়িয়েছেন ও - কিন্তু আজকে ছোট্ট একটা ঘটনা হয়ত সেই সমর্থন টুকু ও আমার উপর থেকে সরিয়ে নিল। মা এর কোন দোষ ছিল না - বাবার বাধার কারনে মা বাধ্য হলেন আমাকে আন্দোলনের ব্যপারে সমর্থন করা বন্ধ করতে । জানি না কবে এই বাধা ভাংতে পারব , জানি না কবে আবার মিছিলে , মানব বন্ধনে স্লোগান তুলতে পারব "জয় বাংলা " বলে । পদে পদে এত বাধা কেন ? এত বিরোধিতা কেন ? নাহ , ঠিক ই আছে । বাধা যদি নাই থাকবে তাহলে আর সংগ্রাম হল কি ? আমি আমার অন্তরে জাগিয়ে রেখেছি আমার ভালোবাসাকে , আমার শাহবাগ কে , আমার জাতীয় পতাকাকে , আমার বাংলাদেশকে । বুকের ভেতর বাচিয়ে রেখেছি "জয় বাংলা " স্লোগান কে , জাগিয়ে রেখেছি "আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালোবাসি " কে । চিরন্তন সত্য এই ভালোবাসার জন্য সত্যি সব কিছু ত্যাগ করতে পারি , পারব।

ভাষার বিয়ে হচ্ছে আরেক শিবির কর্মীর সাথেই - তার ভাইয়ের বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে হচ্ছে তার বিয়ে । মেয়েটা এক সময় বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখত , সেই মেয়ে আজকে ছাত্রী সংস্থার সদস্য , সেই মেয়ে আজকে শিবির কর্মী কে বর হিসেবে পেয়ে খুশি । ধর্মান্ধতা এভাবেই মানুষকে অধপতনের দিকে নিয়ে যায় , এতই অন্ধ করে দেয় যে মানুষ নিজের ভাল টাও চোখ মেলে দেখতে পারে না । ভাষা কি সুখী হবে ? আমার মনে হয়না ।  শিবির আর ছাত্রী সংস্থার বিয়ে -  ঘৃণা ভরে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কিছুই করতে পারি নি । একদিন হয়ত ভাষা তার ভুল বুঝবে , কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে । 

কাদের কসাই এর ফাসির রায় হলে একটা খুব ছোট ইচ্ছা আছে আমার - ভাষার সামনে , আমার বাবার সামনে , আমার কলেজের সামনে একবার অন্তত বলব - "আজ আমার দাবি পুরন হয়েছে । আজ আমি বিজয়ী । তোমাদের প্রত্যাখ্যানের , অপমানের জবাব আমি দিতে পেরেছি , আমার সব প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেছে ।" কি জানি , আসবে ত সেই সুদিন ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন