রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

শাহবাগে রাত ভোর , স্মৃতিতে একাত্তর । নব ইতিহাসের সাক্ষী রইল প্রজন্ম চত্বর ।

একটি মেয়ে , নাম অপ্সরা । ছোটবেলা থেকে মা বাদে আর সবার কাছে শুধু উপেক্ষাই পেয়েছে সে । অনেক ছোট বেলায় , কেবল কথা বলতে শিখেছে তখন - ওর নানু বাড়ির লোকেরা ইচ্ছা করে ওর গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয় , পোড়া শরীর , সারা শরীরে ব্যন্ডেজ করা মেয়ে কে নিয়ে ওর মা সৌদি আরবে ওর বাবার কাছে চলে যান । কিন্তু এই মেয়ের কারো সাথেই যেন বন্ধুত্ব হতে মানা - বাবা সিগারেট খেতে গেলে সে সিগারেট নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় একদিন , বাবার বিরাগভাজন হয়ে যায় সেদিন থেকেই ।
অতটুকু মেয়ে বুঝত কিভাবে যে সিগারেট খারাপ ? এই ব্যপার টা হয়ত রহস্যই থেকে যাবে । এরপর সৌদি আরবেই স্কুলে ভর্তি হয় অপ্সরা । কিন্তু , ও সব জায়গাতেই কেন যেন সবার সাথে মিলতে পারে না। স্কুলে ক্লাস শুরু হলে ও কান্নাকাটি শুরু করে , ওর মা কে ক্লাসরুমে এসে ওর কান্না থামাতে হয় । মেয়েটি সব পরীক্ষায় প্রথম হয় , কিন্তু খুব ই ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের ।কিন্তু স্কুল টাকে অপ্সরা কেন যেন অনেক বেশি ভালবাসত ।একদিন বাংলাদেশ থেকে খবর আসে যে ওর নানা মারা গেছেন । অপ্সরা , তার বাবা - মা আর ছোট ভাই তখন দেশে চলে আসে । বাংলাদেশে এসে খুব দ্রুতই নিজেদের জীবন গুছিয়ে নেয় পরিবারটি । অপ্সরা কে একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেয়া হয় । তখন অপ্সরা ক্লাস ২ তে পরে । একবার সেই কিন্ডারগার্টেনে একটা গল্প লেখার প্রতিযোগিতা হয় । অপ্সরা তার কাঁচা হাতে যে গল্পটি লেখে তা শিল্পগুন বিচারে খুব উচুমানের না হলেও গল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল একটা চাওয়া - রাজাকারের ফাঁসি চাওয়া !!! কিন্ডারগার্টেনের প্রধান ছিল একটা হুজুর ধরনের লোক , গল্প দেখে তার মাথা খারাপ হবার জোগাড় । অপ্সরার বাবা- মা কে ডেকে তখনি অপ্সরাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় ।

সেদিন বাসায় বাবা- মা অনেক ঝগড়া করছিল । বাবা বার বার বলছিল , এতটুকু মেয়ে রাজনীতি বোঝে কেন । অপ্সরা বুঝতে পারছিল না যে সে রাজনীতির কি করেছে । শুধু বুঝতে পেরেছিল তাকে তার স্কুল থেকে খুব কঠিন কোন শাস্তি দেয়া হয়েছে , যেটার মানে সে আর কখনও সেই স্কুলে যেতে পারবে না । সাত বছরের মেয়েটি খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় সেদিন । পরে মা ওকে নিয়ে গিয়ে একটা ভর্তি কোচিং সেন্টার এ ভর্তি করে দেয় । বছরের বাকি সময়টা মন দিয়ে পড়াশুনা করে একদিন ভিকারুন্নিসা স্কুলে ক্লাস থ্রি তে চান্স পেয়ে যায় ও । বরাবর ই অপ্সরা পড়াশুনায় ভাল , ভিকারুন্নিসায় তার প্রমান রাখতে থাকে সে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত একবার বাদে অন্য কোন পরীক্ষায় ওকে কেউ প্রথম থেকে তৃতীয় এ ছাড়া অন্য কোন ফলাফল করতে দেখে নি । ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে মেয়েটি নিজেও বুঝতে পারে সে আর স্বাধীন নেই । স্কুলের শিক্ষক রা চায় মেয়েটি তাদের কাছে পড়ুক , কিন্তু মেয়েটির ভাল লাগে না । ফলে সব শিক্ষক দের ধীরে ধীরে চক্ষুশুল হয়ে যায় অপ্সরা । ইচ্ছা করে স্কুলের সবাই ওর বিরুদ্ধাচরন করতে থাকে । এর প্রভাব পরে শিক্ষক দের খাতা দেখার ক্ষেত্রেও । ফলে এক বছরের মধ্যে স্কুলে অপ্সরা খুব ই খারাপ একটা মেয়ের পরিচিতি পায় ।কিন্তু এবার ও অপ্সরা নিজেকে গুছিয়ে নেয় । জুনিয়র স্কলারশিপ এক্সামিনেশনে ওদের থানাতে প্রথম স্থান পায় অপ্সরা ।

ক্লাস নাইন থেকে স্কুল চেঞ্জ করে অপ্সরা আইডিয়াল স্কুলে চলে আসে । এতদিন ধরে কখনও ওর কোন বন্ধু ছিল না  কিন্তু এবার কেন যেন ক্লাসের সবার সাথে ওর খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । ও সবার ব্যবহারিক করে দেয় , পরীক্ষার হলে যে যা জিজ্ঞাসা করে কিছু বলে দিতে কার্পণ্য করে না , সুন্দর সম্পর্ক হবে না ই বা কেন ? কিন্তু ওর বিপদের সময় দুধের মাছিরা সরে যায় । অনেক বার এরকম হওয়া স্বত্বেও অপ্সরা সেই দুধের মাছিদের বন্ধুত্বের জন্যই ছটফট করে ,তাদের জন্যই নিজের পরীক্ষা খারাপ করে , তাদের জন্যই ক্লাস মিস দিয়ে ব্যবহারিক করে। এস এস সি পরীক্ষা হয় , ঢাকা বোর্ড এ বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী দের মধ্যে প্রথম হয় অপ্সরা । বৃত্তির রেজাল্ট বের হওয়ার অনেক আগেই অপ্সরা  আর তার সহপাঠীরা সবাই অন্য কলেজে চলে এসেছে । সেখানে সেই সুবিধাবাদি বন্ধুরা বার বার ওকে বিপদে ফেলেছে । যাই হোক , রেজাল্ট টা পাওয়ার পর অপ্সরা সব কিছু আবার গুছিয়ে নিতে আশাবাদী হয়ে ওঠে ।

নতুন কলেজে ভাষা নামের একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয় অপ্সরার । আগের ভুল আবার করে সে , ভাষা কে অনেক আপন ভাবতে শুরু করে । এর মধ্যে আসে ৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৩ । রাজাকারের ফাসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ । মেয়েটিও যোগ দেয় সে আন্দোলনে । আন্দোলনে যাওয়ার জন্য কলেজ থেকে সাময়িক ভাবে বহিষ্কৃত হতে হয় তাকে । এরপর আবার সেই স্কুল জীবনের ঘটনার ই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে । সবার চোখে অনেক খারাপ এই মেয়েটি নিজেকে প্রশ্ন করে এবং উত্তর পায় , লোকে কি বলে দেখার দরকার নেই , তুমি লড়ে যাও । শিক্ষক রা ছাত্রীদের বলেন অপ্সরার থেকে দূরে থাকতে , সবাই দূরত্ব বজায় রাখতেও শুরু করে । শত্রুশিবিরে বসে যেন মুক্তির গান গাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে অপ্সরা । আস্তে আস্তে শাহবাগ আন্দোলন টা কে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলে অপ্সরা । তার জীবনের একটাই লক্ষ্য হয়ে ওঠে , স্বাধীন বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হতেই হবে । অপ্সরার কোন কাছের মানুষ নেই আর , মা ছাড়া সবাই তাকে অনেক আগেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে । কাজেই আর কারো ভালোবাসা হারানোর ভয় নেই তার । শুধু একটাই দাবি , রাজাকারের ফাঁসি ।

কলেজে এর মাঝে ভাষার সাথে অনেক আন্তরিক হয়ে পরে অপ্সরা । কিন্তু এই ভাষাও ওকে ব্যবহার করতে শুরু করে । কলেজের কেউ ওর সাথে কথা বলে না , তাই সামান্য ভাল ব্যবহার ই অপ্সরার কাছে অনেক কিছু তখন । ভাষার প্ররোচনায় ভাষার প্রেমিকের সাথে ভাষার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে থাকে অপ্সরা । তার উপর দিয়ে যে মানসিক কষ্ট টা যেত এসব করতে গিয়ে তা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না । একদিন ভাষার প্রেমিকের সাথে কথা না হলে পরদিন ভাষা আর অপ্সরার সাথে ভাল করে কথা বলবে না , কাজেই সারাদিন অপেক্ষা করে হলেও ভাষার জন্য কাজ করে অপ্সরা ।অপ্সরা জানত না যে ভাষার বড় ভাই শিবির কর্মী ।তাই ৫ মে সেই বড় ভাইয়ের মৃত্যুর মিথ্যা সাজানো কথা ও অপ্সরা বিশ্বাস করে তাৎক্ষনিকভাবে । কিছুদিন পরে ভাষার প্রেমিকের সাথে ভাষার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়  ভাষা এর জন্য অপ্সরা কে দায়ী করতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না । পাশাপাশি অপ্সরার সামনে রাখে অপ্সরার জীবনের কঠিনতম প্রশ্ন - শাহবাগ এবং ভাষা এ দুটির মধ্যে যে কোন একটিকে চয়েজ করতে বলে ভাষা । নিজের জামাত পন্থি মনোভাব ও সে প্রকাশ করে দেয় । অপ্সরা বুঝতে পারে - এ হল দেশ আর বন্ধুত্বের লড়াই । এ লড়াই লড়তে পেরে নিজেকে অপ্সরা ভাগ্যবান মনে করে । নির্দ্বিধায় দেশ কে বেছে নেয় । সেদিন অপ্সরা বুঝতে পারে বুকের মধ্যে জন্মের পর থেকে জেগে থাকা কোন ভালোবাসা তাকে সাত বছর বয়সে রাজাকারের ফাসি চাইতে বাধ্য করেছিল । কিছুদিন পরে সে টের পায় কোন ভালোবাসার টান তাকে বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজাকারের ফাসি চাইতে শিখিয়েছে। এই ভালোবাসা দেশ মা এর জন্য ভালোবাসা , এই ভালোবাসার কারনে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সান্নিধ্য পাওয়া আজ অপ্সরার জীবনের সর্ব শ্রেষ্ঠ পাওয়া । জীবনের টাল মাতাল নৌকার হাল আজ সে সহজেই ধরতে পারে । প্রিয় বান্ধবীর আহ্বানকে সযত্নে এড়িয়ে তার প্রানের দাবি জাগিয়ে রাখতে পারে । রাজপথে মিছিলে স্লোগান তুলতে পারে "জয় বাংলা " বলে ।

জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু । জয় প্রজন্ম , জয় তারুন্য , জয় শাহবাগ । জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের , জয় হোক স্বাধীনতার ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন