সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৩

বাংলাদেশ , অনন্ত অক্ষত মূর্তি জাগে।

স্বপ্ন দেখি ... ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে দাঁড়িয়েও আমরা স্বপ্ন দেখি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ... যে বাংলাদেশে স্থান হবে না কোন রাজাকার - আলবদরের। ইস , পনেরই আগস্ট , ১৯৭৫ দিনটা যদি আসলেই একটা দুঃস্বপ্ন হত শুধু - যদি সত্যিকারেই এমন হত যে আমরা পুরো বাঙালি জাতি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম আসলে ... বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন , তাজউদ্দিন আহমেদ বেঁচে আছেন , জাতীয় চার নেতা বেঁচে আছেন - কত সুন্দর ই না হত তাহলে ব্যাপারটা । তাহলে আর আমাদের দেখতে হত না রাজাকারের বিচারের জন্য গণআদালত গঠন করায় শহীদজননীকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়া , আমাদের দেখতে হত না রাজাকারদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা ... অনেক কিছুই দেখতে হত না - বাবা তার সন্তানদের আগলে রাখতেন দেশদ্রোহীদের হাত থেকে ...। যদি সেদিন ফারুক - রশিদ - মোশতাক - জিয়া - নূর - ডালিম -হুদারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করত , তাহলে আজকে হয়ত আমাদের দেখতে হত না মনির -নাহিদ দের লাশ , অন্তঃসত্ত্বা মায়ের গায়ে পেট্রোল বোমা ছোড়া হত না ... স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি দেশের প্রধান বিরোধী দল হতে পারত না ...। বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করেছিলেন জামাত -শিবিরকে , স্বাধীন বাংলায় আর কখনও শুনতে হত না রাজাকারদের দম্ভভরা পদধ্বনি ...।

কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট দুঃস্বপ্ন নয় , সত্য। . স্বাধীনতা নামক লাল -সবুজ পাখিগুলো নীল আকাশের বুকে উড়তে উড়তে কোথায় হারিয়ে যায় ... শেষ পাখিটা চলে যাবার আগে বলে যায় , কেউ নেই আর... বঙ্গবন্ধু নেই , তাজউদ্দিন আহমেদ নেই , জাতীয় চার নেতার কেউ বেঁচে নেই , মেজর খালেদ মোশাররফ নেই ... মুক্তিযোদ্ধারা , বীরাঙ্গনারা বেঁচে আছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে , বেঁচে আছেন জীবনযুদ্ধের মধ্যে । শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছেন বাঙ্গালির অন্তরে ... স্মৃতিসৌধে ... শহীদ মিনারে। দেশের হালটা ধরার জন্য নেই সত্যিকার অর্থে কেউ ...। মা জাহানারা ইমাম ছিলেন , চলে গেছেন এদেশের মানুষের প্রতি শেষ চিঠি রেখে - " এই আন্দোলনকে সুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। আমি জানি জনগণের চেয়ে বিশ্বস্ত কেউ নেই । জয় আমাদের হবেই...।" এরপর বাংলাদেশ নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে ঝরে গেছে অনেকগুলো পাতা ... ক্ষমতার পালাবদল , রক্তের নেশায় উন্মাতাল রাজনীতি আর তার বলি সাধারন মানুষ ... এসবের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে বিয়াল্লিশ টি বছর ...। বিয়াল্লিশটি বছর নীরবতার , সহ্য করার - এর মধ্যে ১৯৯২ সাল একটা আলোর ঝলক , একটা সাক্ষী যে বাংলাদেশ বেঁচে আছে...।।

অবশেষে ২০১৩ সাল এলো ... কি এমন বিশেষত্ব এই ২০১৩ সালের ? দুই শুন্য এক তিন , নাহ - হতে তো পারত এটা অন্য আরও দশটা বছরের মতই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এই জাতির নাম বাঙালি জাতি । কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক অনেক বছর আগে এই জাতির নামে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন -"সাবাস বাংলাদেশ , এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় - জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।" তাইতো শহীদজননীর স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয় নিয়ে আবার জাগল বাংলাদেশ - একাত্তরের হায়েনাদের ফাসির দাবিতে , বাংলাদেশের বিয়াল্লিশ বছরের কলঙ্কমোচনের দাবিতে। শাহবাগে নামলো জনতার ঢেউ , মুক্তিযোদ্ধা মা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী ভালোবেসে এর নাম দিলেন "প্রজন্ম চত্বর"। নাহ , এ প্রজন্ম কোন রাজনৈতিক দলের ডাকে জাগে নি - সম্পূর্ণ নিজের বিবেকের তাড়নায় প্রজন্ম চত্বরে দিনরাত অবস্থান করেছে সেই কিশোর - কিশোরী , তরুণ - তরুণী যারা অন্তরে লালন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর রাজাকারদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। বিয়াল্লিশ বছরের অভ্যস্ত নীরবতা ভেঙ্গে বাংলার আকাশ -বাতাস কাঁপিয়ে যারা চিৎকার করে বলতে পারে - "জয় বাংলা ."। প্রজন্ম চত্বরে চিৎকার করে জানায় বাংলাদেশ - 'ক তে কাদের মোল্লা , তুই রাজাকার , তুই রাজাকার ," "মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় , রাজাকারের ঠাই নাই।"

আমি একাত্তর দেখিনি , একাত্তরকে জেনেছি ইতিহাসের পাতা থেকে , একাত্তরকে দেখেছি বীরাঙ্গনা মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখের মাঝে , একাত্তরকে উপলব্ধি করেছি "একাত্তরের দিনগুলি"র পাতায় পাতায়। আর একাত্তরের স্লোগান কণ্ঠে নিয়েছি শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে। বাংলাদেশ , অনন্ত অক্ষত মূর্তিতে জাগ্রত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের নাম - যার প্রতি কণা মাটি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা । আর তাই বাংলাদেশ মেনে নিতে পারেনা কোন রাজাকারের দম্ভ। প্রজন্ম চত্বরের নবজাগরণের ফসল কাদের কসাই এর ফাসির রায় , জামাতের নিবন্ধন বাতিল , সাইদি - কামরুজ্জামান - মুজাহিদ - মইন -আশরাফের ফাসির রায়। গোলাম আজম আর আব্দুল আলিমের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ। জানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার অনেক সময়সাপেক্ষ একটা বিচার প্রক্রিয়া। জানি অনেক সময় প্রয়োজন এই প্রক্রিয়া শেষ করতে , কিন্তু সাফল্যের কথা এটাই যে বাংলার মাটি রাজাকারমুক্ত হবার পথে হাঁটছে । যদিও  পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা শেষ করতে সময় লাগলো দুই মাসের উপরে , যদিও রায় লিখা শেষ হওয়ার পরেও তা প্রকাশের জন্য অপেক্ষার প্রহরটা গুণতে হচ্ছে অনেক বেশি - তারপরও আশা হারাই না। একদিন না একদিন সুদিন আসবেই ... এত দূর যখন আমরা এসেছি , শেষ বিজয় আসবেই ...।

যদি লক্ষ্য থাকে অটুট , বিশ্বাস থাকে হৃদয়ে ... দেখা হবে বিজয়ে...। জয় বাংলা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন