শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিজয় আজ প্রজন্ম চত্বরের , বিজয় আজ শহীদজননীর , বিজয় আজ বাঙ্গালির...।

২১ফেব্রুয়ারি , ১৯৫২  - স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়নি তখনও। পাকিস্তানিরা কেড়ে নিতে চেয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি বাঙ্গালির মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার , মা বলে ডাকার অধিকার। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠলো বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের আমতলায় সমবেত হল তারা। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারিতে পথে নেমে আসলো বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানেরা। মায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য , মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাজপথে নামলো দামাল সন্তানেরা। এক একটা বাংলা অক্ষর যে এক একজন বাঙ্গালির জীবন। আন্দোলন ছড়িয়ে পরল দেশের প্রতি প্রান্তে। রাজপথে নামলো ছাত্র -জনতার মিছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে মুখরিত বাংলাদেশ। পাকিস্তানি পুলিশ গুলি চালাল মিছিলের উপর। বাংলা মায়ের বুকে শেষ আশ্রয় নিলেন শহীদ রফিক -শফিক-বরকত -জব্বার। রক্তে প্লাবিত হল বাংলার মাটি। একসময় আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বাঙালি পেল মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার। আজ আমরা মাকে যে মা বলে ডাকি , সে অধিকারটাও রক্তের দামে আদায় করা।
 
৫ ফেব্রুয়ারি,২০১৩ - যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবি জানিয়েছিলেন আম্মা জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালেই। গণআদালত গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির রায়ও দিয়েছিলেন। এজন্য তৎকালীন স্বাধীনতাবিরোধী সরকারের হাতে শহীদজননীকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক নির্যাতন , পেতে হয়েছে দেশদ্রোহীর অপবাদ। অনেক বছর পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ শুরু হয়েছে  , ৪০০ এরও অধিক বাঙালি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত কাদের কসাই এর ফাসি হলনা সেই বিচার প্রক্রিয়ায়। প্রতিবাদে ফুসে উঠলো বাংলার জনতা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আবার রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার শপথ নিয়ে পথে নামলো তারা - জানিয়ে দিল -"এই পথে আজ জীবন দেব , রক্তের বদলা ফাসি নেব"। রক্ত , হ্যা অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে এই পথে। শহীদ রাজীব , দীপ , জগতজ্যোতি , জাফর মুন্সি , শান্ত - ত্রিশ লাখ শহীদের সাথে মিশে আছেন দূর আকাশের নক্ষত্রগুলোর মধ্যে। আর দেখছেন , তাদের রক্তদান সফল হয়েছে। কাদের কসাইয়ের ফাসির জন্য দশ মাস ধরে  আম্মা জাহানারা ইমামের সন্তানেরা মায়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে চালিয়েছে আন্দোলন। কত বাধা , কত আঘাত সবকিছুকে দূরে ঠেলে দিয়ে বাংলার আপামর জনতা ছুটে এসেছে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে , একবার নয় বারবার। ফাসির রায় থেকে শুরু করে ফাসি -আন্দোলন করে আদায় করতে হয়েছে সবকিছুই। তারপরেও , শাহবাগ জেগে আছে -শাহবাগ ঘুমায় না।

১৬ ডিসেম্বর ,১৯৭১ - নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হল। ৭ ই মার্চ ,১৯৭১ এ যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন , সেই রেসকোর্স ময়দানেই আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাংলার আকাশে উদিত হল সেই রক্তিম সূর্য , যে সূর্যের জন্য বারবার রক্তগঙ্গায় স্নান করতে হয়েছে , বারবার দেখতে হয়েছে খাণ্ডবদাহন। যে স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য সখিনা বিবির কপাল ভাঙ্গল , হরিদাসীর সিথির সিদুর মুছে গেল - অনেক রক্তের দামে অবশেষে এল সেই স্বাধীনতা। রবিঠাকুরের অজয় কবিতা , অবিনাশী গান এই সোনার বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হলেন , দুই লাখ মা বোন হলেন নির্যাতিতা। শহীদ রুমী -বদি -আজাদ - আলতাফ মাহমুদ , এক একটি পুষ্পগুচ্ছের মত নাম , কেউ আর ফিরে এলেন না অপেক্ষার প্রহর গোনা মা -বোন -স্ত্রীর কাছে। স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি বধ্যভূমিতে পরে রইল , শহীদ পরিবারের সদস্যরা ছুটে গেলেন নিজেদের প্রিয়জনের সন্ধানে , সন্তানের সন্ধানে। চিরকালের মত হারিয়ে গেলেন অনেক মায়ের বুকের মানিক , এনে দিয়ে গেলেন স্বাধীনতা।স্বাধীনতা , এত রক্ত আর এত অশ্রুর বিনিময়ে কিনতে হয়েছে এই মহান স্বাধীনতা যে বিজয়ানন্দ চাপা পরে যায় অশ্রুর অন্তরালে।

১২ ডিসেম্বর ,২০১৩ - বিয়াল্লিশ বছরের অভ্যস্ত নীরবতা ভেঙ্গে ৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৩ তে বাঙালি যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিল তার প্রথম বিজয়সোপান রচিত হল এইদিন রাত ১০ টা ০১ মিনিটে। কাদের কসাইয়ের ফাসি কার্যকর হল শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে আপামর জনতার ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে। আমি গর্বিত বাংলা মায়ের কলঙ্কমুক্তির আন্দোলনের অংশ হতে পেরে। আজ মনে হচ্ছে আমাদের সব আন্দোলন , রাতজাগা , মিছিল , স্লোগান , কলেজে শাস্তি পাওয়া শাহবাগে যাওয়ার জন্য , পারিবারিক বাধাকে না বলে বারবার শাহবাগে ছুটে যাওয়া - সব তো এই দিনটার জন্যই ছিল। আজ মনে হচ্ছে শাহবাগে যে শপথ লাখ লাখ বাঙালি এক হয়ে নিয়েছিলাম , সে শপথ আমরা রক্ষা করতে পেরেছি। আজ আমরা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বদলা নিতে পেরেছি , পেরেছি দুই লাখ বীরাঙ্গনা মায়ের উপর নির্যাতনের বদলা নিতে। আজ শহীদ মেহেরুন্নেসা ন্যায়বিচার পেয়েছেন , ন্যায়বিচার পেয়েছেন বীরাঙ্গনা মা মোমেনা বেগম। আজ অন্তর থেকে বুঝতে পারছি বিজয়ানন্দ কি জিনিস , একাত্তরের ১৬ ই ডিসেম্বরে বাংলার মানুষের , মুক্তিযোদ্ধাদের অনুভূতি টা বুঝতে পারছি। আমি গর্বিত শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের অংশ হতে পেরে। আজ আমরা , বাংলাদেশের সাধারন মানুষেরা রচনা করলাম একাত্তরের পর আরেকটি বিজয় , প্রতিপক্ষ তো সেই এক ই। আজ অন্তর থেকে আপনাআপনি বার বার বের হয়ে আসছে প্রজন্ম চত্বরের বুকফাটা চিৎকার - বিজয়ানন্দে উল্লাসিত জয় বাংলা ধ্বনি। মা জাহানারা ইমাম আজ বিজয়ী , শাহবাগ আজ বিজয়ী , বাংলাদেশ আজ বিজয়ী।
 
এই দিনটার জন্যেই তো এত অপেক্ষা , এত আন্দোলন সবকিছু। আজ আনন্দে কি করব কিছু বুঝতে পারছি না । শুধু বলতে পারি , বাংলার নরম পলিমাটিতে বার বার এভাবেই ফিরে আসে ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের জয় , জনতার জয় , বাঙ্গালির জয় চিরদিন ই হবেই। একাত্তরের পরাজিত হায়েনারা বারবার পরাজিত হয় , বারবার পরাজিত হবে এই বাঙ্গালির হাতেই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জাগিয়ে রাখবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত শাহবাগের দীপশিখা। প্রতিবাদের ভাষা , প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ দারুন প্রতিশোধে জ্বলে উঠবে বায়ান্ন , উনসত্তর , বিরানব্বই , একাত্তর , ২০১৩ এর মত বারবার। বাংলার মাটিতে বারবার পরাজিত হবে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি - অতীতের মত , বর্তমানের মত।আগামীকাল সকালের সূর্য উঠবে প্রজন্ম চত্বরের বিজয় ধারক হয়ে , কাদের কসাইমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম সূর্যোদয় হয়ে।  ২০১৩ এর বিজয় দিবস হবে ইতিহাস , কসাই কাদেরমুক্ত বাংলার প্রথম বিজয় দিবস।
 
৫ ফেব্রুয়ারিতে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম - এই কাদের কসাইয়ের ফাসি না হওয়া পর্যন্ত নিজের জীবনের কোন কিছুকেই আমি আমার প্রজন্ম চত্বরের উপর স্থান দিব না। শাহবাগ বাদে কোন কিছুকে এতটা গুরত্ব দেব না যা আমার জীবনের কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পেরেছি। জীবনের সবকিছুর উপরে প্রজন্ম চত্বরকে স্থান দিতে পেরেছি। আজ কাদের কসাইয়ের ফাসি হয়েছে - এই লাইন টা লেখার সাথে সাথে চোখ থেকে আনন্দাশ্রু অঝোরে গড়িয়ে পরছে। সবশেষে একটা কথাই বলার আছে -
 
"শাহবাগে রাতভোর , স্মৃতিতে একাত্তর
নব ইতিহাসের সাক্ষী রইল প্রজন্ম চত্বর।"
 জয় ...বাংলা...।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন