শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৪

এক মুঠো রোদ ধরতে চাই...

মায়াবী জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো পরম মাতৃ মমতায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে সমগ্র সৈকত টিকে। সাগরের উন্মাতাল জলরাশি আছড়ে পরেছে সমুদ্রতীরে , বালুবেলাকে স্নান করিয়ে দিয়ে আবার ফিরে চলেছে সমুদ্রগর্ভে । জ্যোৎস্নার মায়াবিনী আলোয় ভিজতে আসা জীবনের ভিড় চারপাশে। জীবনগুলো বারবার ঝাঁপিয়ে পরছে উত্তাল ঢেউএর সাগরের মাঝে, আহরণ করছে কিছু অমূল্য ঝিনুক কিংবা মুক্তো। পর্যটক দল হয়ত পরদিন খুব ভোরে এসে অর্থের বিনিময়ে খুব সহজেই নি...জেদের করে নিতে পারবে এই মুক্তো গুলোকে। কিন্তু , মাঝরাতে স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় চরাচরব্যাপী জ্যোৎস্নার মাঝে সমুদ্রে ডুবসাঁতার কেটে একটি মুক্তো আহরণ করে সঙ্গিনীর হাতে তুলে দেয়ার স্বর্গীয় আনন্দ তাদের অনুভবের জগত থেকেও অনেক দূরে। শিউলি মালা গাঁথতে গিয়ে গ্রাম্য কিশোরীর মুখে ফুটে ওঠা হাসি , কিংবা দাওয়ায় বসে নকশী কাঁথার বুকে নিজের জীবনের স্বপ্নকে ফুটিয়ে তোলার অপার্থিব আনন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না কোন ফাইভ স্টার হোটেল বা অত্যাধুনিক পার্টি হলে...

মৌসুমি হাওয়া হয়ত শুনতে পায় অগ্রসরমান জাহাজের পদধ্বনি ; অনাগত ভবিষ্যতের দুর্নিবার জলস্রোতের আশায় পথ গোনে হাজার ক্লান্ত পথিক। জাহাজ একদিন এসে কূলে পৌঁছায় , মাঝিমাল্লারা নেমে আসে ; নেমে আসে জাহাজের ক্যাপ্টেন। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যে সুনির্দিষ্ট যোগসূত্র রেখাই যে যোদ্ধাদের টেনে এনেছে এই বর্তমানে। তীরহারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে ৪২ বছরের সমুদ্রযাত্রা শেষে জাহাজ এসে পৌঁছেছে প্রজন্ম চত্বরে। দুর্যোগের ঘনঘটা ছাপিয়ে আকাশ -বাতাস কাঁপিয়ে আজ শুধুই মুক্তির গান। তিমিরবিদারী তারুন্য যে আজ পৌঁছে গেছে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে। মানবতার মুক্তির জয়গান গেয়ে জাগ্রত প্রজন্ম বিজয় এনেছে আবার , অগ্রজ মুক্তিসেনার আশীর্বাদ আর বীরাঙ্গনা মায়ের অমর কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান এই প্রজন্ম যোদ্ধাদের পথের পাথেয়। হাতিয়ার ? অক্ষয় দেশপ্রেম আর দুর্জয় স্লোগান ; যে স্লোগান যুগে যুগে ভিত কাপিয়ে দিয়েছে শাসকের , শোষকের , পাকিস্তানের আর রাজাকারের।


লড়াই শেষে যোদ্ধাদের আবার ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। মারনাস্ত্রের সাথে এই তারুন্যের প্রেম যে চিরকালের। ভালবাসার আহ্বান তুচ্ছ করে যুগে যুগে বারবার এই মারনাস্ত্রের সাথেই তো অমর প্রেমে আবদ্ধ যোদ্ধারা। যখন যেভাবে প্রয়োজন , কখনও পাকসেনার ভীরু কামানের মুখে বীর মুক্তিসেনার দুর্জয় রাইফেল হয়ে , কখনও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসেও মুক্তির স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে প্রাণপ্রিয় সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করার মধ্যে , আবার কখনও ফাঁসির দাবি করে , একাত্তরের পরাজিত প্রতিপক্ষ আর রাজাকার -জামাত -শিবিরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের উপর দিয়ে চলমান সাঁই সাঁই চাপাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে জয় বাংলা বলে চিৎকার করে ওঠার মধ্যে। বিপ্লবীর সাথে মারনাস্ত্রের এই প্রেম অনন্তকালের। আবার যদি কখনও সাগরের উত্তাল জলরাশিকে ঢেকে দিতে চায় নিরাশার কালো মেঘ , আবার যদি কখনও কিশোরীর উচ্ছল হাসিকে আঘাত করতে এগিয়ে আসে কোন কালো থাবা ; তবে প্রতিজ্ঞা রইল মারনাস্ত্র - আবারও সেদিন প্রেম হবে তোমার আমার। পৃথিবীটাকে ভালোবাসা আর বিপ্লবের রঙে সাজাতে , কিছু ভালোবাসাকে তো বিসর্জন দিতেই হয়...

জানালার গরাদ ভেদ করে উদীয়মান সূর্যের কিছু আলোকরশ্মি এসে পরেছে। অনেককাল আগে হারিয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি শত বিজয়ের আনন্দের মাঝে একটু নাড়া দিয়ে যেতে এসে হাজির হয়েছে। সেগুলো , শুধুই স্মৃতি। শুধুই অতীত , শুধুই হারিয়ে যাওয়া এক একটা অধ্যায়। জাহাজটি সচল হয়ে উঠছে আবার। সেই যাত্রা সূচনা করতে হবে আরও একবার। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে , মানুষে মানুষে ভালোবাসার , ভ্রাতৃত্বের জয়গান গাইবার সময় এসেছে আবার। অতীত ইতিহাস বিপ্লবের , বিজয়ের - বর্তমানটা হোক মানবপ্রেমের। স্বপ্নচারী কলমের কালিতে অনেক স্বপ্নজয়ের ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে।বন্দীশিবির থেকে মুক্তির আলোতে পা বাড়াবার সময় আজ। বাগানের ছোট ছোট গোলাপের কুড়িগুলো থেকে ফুল ফুটে গেছে অনেক আগেই। সবুজ পাতার মাঝে লাল টকটকে গোলাপগুলো শিশুর মত নিষ্পাপ চাহনিতে চেয়ে আছে। এত লাল কেন ফুলগুলো ? স্বাধীন দেশের রক্তলাল পতাকাটার মত। সবুজের বুকে লাল ঐ বৃত্তটাতে যে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে...


নীল আকাশটা জুড়ে এলোমেলোভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিদের দল। কিচিরমিচির শব্দে দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা। একাকী তরুণী আকাশী রঙের প্রিয় শাড়িটা পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে , চেয়ে আছে দূর আকাশের স্বাধীন পাখিদের দিকে। অশ্বপৃষ্ঠে নয় , মাটিতে আসীন তরুণী। রক্তাক্ত তরবারি নয় , হাতে মেহেদি পাতার রঙ। দুচোখ জুড়ে ভালবাসায় ভরা এক আগামীর স্বপ্ন। সবকিছুকে আবার নিজের মনের মত করে সাজিয়ে নেয়ার স্বপ্ন। নিশ্ছিদ্র এক নীরবতাকে ভালোবাসার ফুলে সাজানোর স্বপ্ন। গাছের ডালে একটি দোয়েলকে ডাকতে শুনে দোয়েলটার সন্ধান করার স্বপ্ন। প্রজাপতির পিছু পিছু রঙ্গিন পাখার সন্ধানে ছুটে চলার অকৃত্রিম আনন্দ। সমুদ্রসৈকতে নির্জন বালুবেলায় একা বসে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন। সাগরের ঢেউ এ দুই পা ভিজিয়ে বসে থাকার স্বপ্ন। উত্তাল ঢেউগুলোর মাঝে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। খুব ছোট ছোট কিছু আনন্দ , কিন্তু এই আনন্দগুলোর জন্যই জীবনটা আজও সুন্দর। একটা নতুন শুরু , আজ যে বড় প্রয়োজন...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন