রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৪

আলোকপ্রদীপ।

রক্তে আগুন ধরা সেই স্লোগানে, স্বাধীনতা এনেছিল কোটি কোটি প্রাণে। রক্তে কাঁপন তোলো সেই প্রিয় গানে, স্বাধীনতা এনেছিল শত কোটি প্রাণে। এবারের সংগ্রাম, ন্যায়বিচারের সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম ন্যায়বিচারের এক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম..."আজকে বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা ছিল।প্রশ্নপত্র খুলে "বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম" নামে রচনাটা দেখা মাত্রই আমার মাথায় এই লাইনগুলি চলে আসল।আর সাথে সাথেই যেন চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই পানি ঝরতে লাগল। কোনোরকমে চোখের পানি আড়াল করে লিখতে বসলাম। তখনই আমি ঠিক করেছিলাম যে এই রচনাটাই লিখব। কিন্তু এই রচনা শুরু করার সাথে সাথে আমি কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছিলাম না। বুঝলাম যে আমার পক্ষে সম্ভব না বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখার সময় একদম স্বাভাবিক থাকা। এত জীবন, এত রক্ত, এত অশ্রুর স্মৃতি এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। তার কতটুকুই বা আমি জানি আর কতটুকুই বা ধারণ করতে পেরেছি ? যতটুকু জানি তাই তো আমাকে স্থির থাকতে দেয়না। হাসতে হাসতে রচনা লিখতে দেয়না। কোন মানে নেই হয়ত, কিন্তু তারপরেও আমার যে প্রতিমুহূর্তে মনে হয় আমরা যাতে হাসতে পারি, বাঁচতে পারি সেইজন্যে, শুধু সেইজন্যে ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। এই যে আমি ভাল আছি, এই ভাল থাকার পিছনে আমার মত, আমারই বয়সী অসংখ্য মেয়ের আত্মদান জড়িয়ে আছে। যে ছেলেটা বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগকে নিজ হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাদের জন্য স্বাধীন মানচিত্র আনতে ছুটে গিয়েছিল, যে মেয়েটা নির্যাতিত শরীর নিয়ে মৃত্যুর আগে শেষ কম্পিত উচ্চারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়ে গিয়েছিল...

নাহ, আমি আর ভাবতে পারিনা। চোখ ফেটে জল আসে আমার। রচনা পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। এক ঘণ্টার মধ্যে এই রচনা লিখা সম্ভব না। যুগ যুগ ধরে লিখলেও বাদ থেকে যাবে এই আত্মদানের অসংখ্য না জানা কথা। পরীক্ষা শেষ করে ফিরে এসে ভাবছিলাম, আচ্ছা আমি কতোটুকু পারলাম আসলে ? এই শহীদেরা, বীরাঙ্গনারা আমাদের এত কিছু দিয়েছেন...নাহ, এর পর আমি আর ভাবতে পারিনা। আমি তো ছুটে গিয়েছিলাম ন্যায়বিচারের দাবিতে। স্লোগানে, গানে, লেখায় আমরাই তো জাগিয়ে তুলেছিলাম খুব নিষ্ঠুর রকম নীরব একটা সময়কে। মা এখনও বলেন, "গত একটা বছর তুই যেন একদম অন্য মানুষ ছিলি। হাসতি না, কারো সাথে কথা বলতি না। শুধু তোর শাহবাগ আর লেখালেখি। তোর লাইফে যে আরও কেউ আছে, এই জিনিসটা তো তোর খেয়ালই ছিল না এতদিন!" মা তো তাও পুরো দৃশ্যটা জানেন না। অনলাইনে লেখালেখির কারণে যে হ্যারাসমেনটগুলো সহ্য করতে হয়েছে তার কানাকড়িও মা জানেন না। মা ভয় পাবেন এগুলো জানলে। তাই জানাতে চাইনা। নিজের কষ্ট নিজের মাঝে সহ্য করার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে...যাহ্‌, কোন কথা থেকে কই চলে গেলাম। বলছিলাম, এসব ভাবলে মনে হয় নাহ, আমি অকৃতজ্ঞ না। আমরা অকৃতজ্ঞ না। নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করেছিলাম। বিয়াল্লিশ বছরের ঘুমন্ত জাতি জেগেছিল আমাদের শাহবাগের হাত ধরেই। আমি হুইলচেয়ারে করে বৃদ্ধা মাতাকে শাহবাগে ছুটে আসতে দেখেছি,জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে চোখ মুছতে দেখেছি।


ঐযে, এইসব লিখতে গিয়ে আবার কান্না পাচ্ছে। কেন কান্না পাচ্ছে ? জানি না। হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিটা মনে করার কারণেই। নিজের দেশের জন্য কিছু করতে পারার চেয়ে সুন্দর স্মৃতি আর কি ই বা হতে পারে ? প্রথম যেদিন আমি আর আম্মু শাহবাগ গিয়েছিলাম, কাউকে চিনতাম না চারপাশে। তবু সবাইকে মনে হচ্ছিল কত জনমের আপন। একান্ত আপনজনের মত আমাদেরকে বসার জায়গা করে দিল আশেপাশের সবাই, একসাথে খাবার ভাগ করে খাওয়া। অনেক বছর পর আবার সেই চিরকালীন আত্মীয়তার বন্ধনে বেঁধেছিল শাহবাগ বাঙ্গালিকে। সময় এগিয়ে গেছে অনেকদূর। শাহবাগকে ভালবেসেছিলাম সেই ফেব্রুয়ারি থেকেই। এরপর, সব সময় শাহবাগের সাথে থাকার চেষ্টা করেছি নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে। শাহবাগ আমার অস্তিত্বের একটা অংশ এখন। অনেক কিছু হারাইসি শাহবাগের জন্য। কলেজে অবস্থান, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা অনেক কিছু। জামাতের আক্রমণের চিহ্ন শরীরে নিয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু এইসব কিছুর কথা মনে থাকে না যখন ভাবি কাদের কসাইরে ফাঁসি দেয়াইতে পারসি আমরা। নিজের অজান্তে আনন্দাশ্রু চলে আসে আমার চোখে। বিশ্বাস করেন, কোন ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩ এর কাহিনী তাও আমার আজো অনেক খুশি লাগে এই সুদীর্ঘ আন্দোলনের প্রথম বিজয়স্তম্ভটা চিন্তা করলে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এই মার্চ, এই চৌদ্দ মাসের স্মৃতি আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে আপন। আমার মনের কথাগুলো চিৎকার করে বলার সাহস আমাকে দিয়েছে এই শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর। ঘরে ঘরে এক একটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে এই শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর।

ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো যখন শাহবাগে এসে স্লোগান ধরে, "জয় বাংলা..." তখন মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর পৃথিবীতে নাই। বায়ান্ন দেখিনাই, উনসত্তর দেখিনাই, একাত্তর দেখিনাই, বিরানব্বই দেখিনাই। তবু ইতিহাসের পাতায় আর সেলুলয়েডের ফিতায় চিরকাল খুঁজেছি তাকে। যতটা পেয়েছি, আপন করে নিয়েছি। শাহবাগ আমাকে যেন একাত্তরের দিনগুলিতে আম্মার হাতে বর্ণনা করা আগুনঝরা ঐ দিনগুলোতে নিয়ে গিয়েছিল। শাহবাগে একটানা অবস্থানের সময়গুলোতে মাঝে মাঝে বিশ্বাস হতে চাইত না এত সুন্দর একটা ইতিহাসের মাঝে আমি বসে আছি। বড় ভালোবাসি এই শাহবাগকে। এই প্রজন্ম চত্বরকে। এই গণজাগরণকে। বারবার এখানে ফিরে যেতে চাই আমি, বারবার রক্তে কাঁপন ধরা সেই স্লোগান তুলতে চাই। আঘাত আসবেই। আম্মা জাহানারা ইমামকেও রাজাকারের ফাসির জন্য আন্দোলন করার কারণে অপমান হইতে হইসে, এই দেশেরই কিছু মানুষ কিন্তু বঙ্গবন্ধুকেও বাঁচতে দেয়নাই। প্রজন্ম চত্বরের যোদ্ধাদের উপর যখন আক্রমণ করা হয় তখন তাই অনেক কাঁদি, প্রচণ্ড কষ্টে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাইনা। দেশটা আমাদের মা। মায়ের জন্য সংগ্রাম করি আমরা। মায়ের বুক থেকে তার সন্তানদের খুনিদের, ধর্ষক দের বিতারিত করার জন্য সংগ্রাম করি আমরা। আমি কোন রাজনীতি বুঝিনা। আমি শুধু এতোটুকু বুঝি যে, আমার রাজাকারের ফাসি চাই। জামাত শিবির নিষিদ্ধ চাই। এই দাবিটুকু পূরণ করার জন্য কত সংগ্রাম, কত ত্যাগ এসব কিছুর পুরা চিত্রটা ধারণ করা কারো পক্ষে সম্ভব না। শহীদ জাফর মুন্সির মৃতদেহটা তুমি ছবিতে ধারণ করতে পারবা, যে স্বপ্নের জন্য লোকটা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলে সেই স্বপ্নটা ক্যামেরায় দেখাইতে পারবা ? পারবা না।

এইযে স্বপ্নটার কথা বললাম, এই স্বপ্নটাই আসলে আমাদের সব। রাজাকার কাদের কসাইয়ের ফাঁসি হয়েছে। শাহবাগে মূলত গেসিলাম এই কাদের কসাইয়ের ফাসির রায় হয়নাই এইটা সহ্য করতে না পেরেই। সেই কাদের কসাইয়ের ফাঁসি আমরা আদায় করসি। হ্যা, আমি গর্ব করে বলব যে সেই কাদের কসাইয়ের ফাঁসি আমরা আদায় করে ছেড়েছি। তবে শাহবাগের মূল সফলতা কোথায় জানেন ? বাংলাদেশকে জাগানোর মধ্যে। রাজাকারদের দিকে আঙ্গুল তুলে তুই রাজাকার বলে সম্বোধন করার এই সাহস পঁচাত্তরের পর থেকে ২০১৩ এর আগে পর্যন্ত কে কবে করতে পেরেছিল ? খোলা রাজপথে দাঁড়িয়ে কোন রকম রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া "জয় বাংলা..." বলে চিৎকার করার দুর্বার সাহসটাকে বাঙ্গালির মধ্যে আবার ফিরিয়ে এনেছে এই শাহবাগ। শাহবাগের প্রতিটা মুহূর্তের স্মৃতি আমার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে বেশি পবিত্র। আমি শাহবাগে গিয়েছি কাদের কসাইয়ের ফাসির জন্যেই। ফাসি আদায় করেছি। জাফর ইকবাল স্যার গত ২৬ মার্চে শাহবাগের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, "এই গণজাগরণ মঞ্চের তরুনেরা যা করে দেখিয়েছে পৃথিবীতে আর কোথাও তার তুলনা নাই। কয়েকজন তরুন মিলে রাস্তায় আন্দোলন করে দেশের আইন সংশোধন মরে অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে, দুনিয়ার আর কোথাও এরকম নজির পাওয়া যাবে না।" এই তরুনদের একজন হতে পেরে আমি গর্বিত। সত্যি, নিজেকে নিয়ে এই একটা ব্যাপারেই আমি গর্ব করি আর তা হল, আমি শাহবাগের একজন কর্মী। আমি মঞ্চে উঠি নাই কখনও। তবে গণজাগরণ মঞ্চের জন্য কাজ করি অন্তর থেকে। আমাকে কেউ শাহবাগে ডেকে নিয়ে যায়নাই। নিজের কোন স্বার্থের জন্য শাহবাগে যাই নাই। গিয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য, আমার অন্তরের সুপ্ত চিৎকারগুলো একটা ভাষা খুঁজে পেয়েছিল এই শাহবাগেই। সে ভাষা প্রতিবাদের, দাবি আদায়ের।

একাত্তর চিরকাল থাকেনি। বিরানব্বইও চিরকাল থাকেনি। দুই শূন্য এক তিন সালটাও চিরকাল নেই। যদিও এটাই বাস্তবতা, তবু খুব কষ্ট লাগে এটা ভাবলে যে ২০১৩ এর সেই আগুনঝরা দিনগুলো আর কখনও আসবে না। তারপরও জীবন এগিয়ে চলবে। গণজাগরণ কখনও শেষ হয়না। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল যে গণজাগরণ প্রতিটা বাঙালি অন্তরে জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেই গণজাগরণ তো কখনই নিভে যাবার নয়। আম্মার জ্বালিয়ে দেয়া মশালটা বিরানব্বই থেকে ধীক ধীক করে জ্বলছিল, তাকে সতেজে জ্বালিয়ে দেয়ার কৃতিত্বটাই শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে, ত্রিশ লাখ শহীদকে আর দুই লাখ বীরাঙ্গনাকে পরম ভালোবাসায় বুকে আঁকড়ে ধরার নামই প্রজন্ম চত্বর। একবার তাদের হাত ধরে এইটুকু বলা যে, "বাবা দেখুন, আমরা অকৃতজ্ঞ নই। নোংরা রাজনীতির পুতুল নই আমরা। আমরা এই প্রজন্ম একাত্তরকে ভালোবাসি। আমরা রাজাকারের ফাসি চাই। জামাত নিষিদ্ধ চাই। মা, আমরা তোমার প্রতিটা অশ্রুর বদলা নিতে চাই" এর নামই প্রজন্ম চত্বর। নিজেদের অন্তরের সুপ্ত প্রতিবাদী চেতনাটাকে কথায়, স্লোগানে, গানে, লেখায় মূর্ত করে তোলার নামই প্রজন্ম চত্বর। আর একেই বলা হয় গণজাগরণ। গণজাগরণের কখনও শেষ হয়না, গণজাগরণের কোন শেষ নেই। বায়ান্ন থেকে শুরু, একাত্তর, বিরানব্বই আর ২০১৩ এর শাহবাগ- গণজাগরণের মশাল জেগে থাকে। কখনও সেই প্রদীপ ধরে রাখা হাতগুলোর উপর একের পর এক আঘাত আসে বটে, কিন্তু প্রদীপে যে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা! কাল থেকে কালান্তরে তা জেগে থাকে। একাত্তর বারবার আসেনা আমি জানি, কিন্তু একাত্তরের পরেও কিন্তু একটা ২০১৩ আসে...।

জীবনের শেষ পর্যন্ত সাথে থাকতে চাই এই গণজাগরণ মঞ্চের। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জয় শহীদজননী, জয় তারুন্য, জয় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন