বৈশাখ, বাংলা বছরের প্রথম মাস। আজ সেই বৈশাখের প্রথম দিন। বাংলা বছরের প্রথম দিন। ১৪২১ সালের প্রথম দিন। নববর্ষ এলেই মানুষ চায় নতুন করে ভাবতে, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে, নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করতে। আর বাঙালি চিরকালই উৎসবপ্রিয় জাতি। বার মাসে তের পার্বণের এই বাঙালি জানে নতুনকে কিভাবে বরণ করে নিতে হয়। তাইত নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে চারপাশে আজকে শুনি দুঃখ তাড়ানিয়া পদধ্বনি। লাল সাদার মেলা যেন বসে পহেলা বৈশাখে বাংলার ঘরে ঘরে। গ্রামীণ জীবনে পহেলা বৈশাখ কেমন হয়, কখনও কাছ থেকে দেখা হয়নি। তবে হালখাতা আর বৈশাখী মেলার গল্প শুনে নিজের মধ্যে যে চিত্রটা কল্পনা করে নিয়েছে গ্রামীণ বর্ষবরণের, তা অনেক বাস্তবতার চেয়েও অপরুপ। বাংলার পথে প্রান্তরে যেন সেই প্রাচীন রুপকথার যুগের রাণী আর রাজকন্যাদের মেলা বসে এই পহেলা বৈশাখে। অপূর্ব রকম স্নিগ্ধ পবিত্রতায় তারা বরণ করে নেন নতুন বছরকে।
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে চারদিকে উৎসারিত নব প্রাণ কোলাহলের বার্তা। আজ দিনটা উৎসবের রঙ্গে রাঙ্গা হওয়ার। আজ দিনটা বাঙ্গালিয়ানার, দিনটা পান্তা- ইলিশের। দিনটা বাংলাদেশের। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা পৃথিবীর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা যে আমাদের হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি কে ভুলে যাইনি, বরং হৃদয় গভীরে ধারণ করে রেখেছি - তার সমুজ্জল প্রকাশ এই পহেলা বৈশাখ। আমরা একদিনের বাঙালি না। আমরা হাজার বছর ধরে বাঙালি। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ছোঁয়া রয়েছে আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে। আর তাই, কর্পোরেট বিশ্বায়নের যুগে যতই আমরা সারা দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলি না কেন, এই একটা দিন আমাদেরকে ফিরে আসতে হয় একদম নিজেদের সংস্কৃতির কাছে। আর এই বাঙালি সংস্কৃতি, পৃথিবীর মানচিত্রে উজ্জল নক্ষত্রের মত জানিয়ে দেয় চিরটা কাল ছোট্ট সবুজ এই বাংলাদেশের নাম। এই সেই বাংলাদেশ, কৃষাণ- মজুর- জেলে- মুটে- কামার- কুমারের এই সে বাংলাদেশ। ষোল কোটি প্রাণের বাংলাদেশ।
জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।
খুব বেশি স্মৃতি নেই এই বৈশাখকে ঘিরে। তবে অনেক ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখে স্কুলে যে অনুষ্ঠান আয়জন করা হত, সেগুলো খুব মনে পরে। একবার খুব ইচ্ছে করছিল, ঐ অনুষ্ঠানে গান গাইব। অনেক জেদ করে "এসো হে বৈশাখ" গানটা শিখেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান গাওয়া হয়নি। এতে উৎসবের আনন্দ এতটুকু ম্লান হয়ে যেত না। সহপাঠী যারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে তাদেরকে সাজিয়ে দেয়া, উৎসব দেখা আর সবশেষে বাতাসা খাওয়া - এইত ছিল পহেলা বৈশাখ। তবে গত বছর, অর্থাৎ ১৪২০ সালের পহেলা বৈশাখ সত্যি অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা ছিল। গণজাগরণ মঞ্চের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিলাম সেদিন। একটা বছর আগে, পহেলা বৈশাখের স্বপ্ন ছিল রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের। সেই স্বপ্নের পথে আজো। আন্দোলনের পরিক্রমায় জেগেছে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রদীপ জ্বলেছে প্রতি ঘরে, ফাঁসি হয়েছে রাজাকার কাদের কসাইয়ের। এই স্মৃতিটুকু, এই সাহসটুকু বহন করেই সামনে এগিয়ে যেতে চাই আরও একবার।
পহেলা বৈশাখ আনন্দের, উৎসবের, মঙ্গলের। মলিন মর্ম মুছিয়ে দিয়ে অগ্নিস্নানে ধরাকে সূচি করে দিতেই যেন প্রতি বছর আগমন হয় এই পহেলা বৈশাখের। যদিও আমাদের সব কাজ কর্ম চলে ইংরেজি বছরের নিয়ম অনুসারেই, তবু প্রকৃত নতুন বছর তো বাঙ্গালিদের জন্য এটাই। সময় অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। সে ছোটবেলা আর নেই। কিংবা নেই ১৪২০ সালও। পহেলা বৈশাখে তাই এখন ইচ্ছে থাকলেও আর ছুটে যেতে পারিনা কোথাও। কিন্তু সে তো বাইরে। ঘরের ভেতর, বুকের ভেতর বর্ষবরণ কে বন্ধ করতে পারে ? আজও তাই নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখি। আবার ভাবি, সবকিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সত্যের জয় যে হবেই। লাল সবুজ পতাকাটা ঐ নীল আকাশের মাঝে সুউচ্চশিরে উড়ে তো এই সাক্ষ্যই দেয়। আর এই আশা, এটাই যে আমাদের একমাত্র সম্বল। আশাকে সম্বল করেই তো আর একবার বেঁচে থাকা। আশাকে সম্বল করেই তো নব জয়যাত্রার কথা লেখা। নতুন আগামীর স্বপ্ন দেখে জাতীয় পতাকাটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে ওঠা, "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি..."
জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন