মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়...

মিছিলটা এগিয়ে চলেছিল কাঁটা বিছানো পথ ধরে। দুর্গম কাঁটাভরা সে পথে প্রতি মুহূর্তে ছিল মৃত্যুর হাতছানি। এইতো, চোখের সামনেই তো জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিলেন একের পর এক যোদ্ধারা। কিন্তু, এই যোদ্ধারা যে মৃত্যুঞ্জয়ী। দৈহিক মৃত্যুর পরও যে তারা অমর। আর তাই মিছিলটা এগিয়ে চলেছিল সেই রক্তেভেজা পথ ধরে। সাথীদের খুনে রাঙা পথ ধরে হায়েনার আনাগোনা আর সহ্য করা যাবে না। একটি নয়, হাজার হাজার- লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে স্লোগান যেন সমুদ্রের গর্জনের মত সবকিছু ছাপিয়ে গর্জন করে উঠছে। উত্তাল সাগরের ঢেউএর মতই জনতার সমুদ্র এগিয়ে চলেছে সমুদ্রের চেয়েও গভীর, গতিময় হয়ে। ঢেউগুলো আছড়ে পরছে তীরে, একের পর এক উদ্যত বজ্রমুষ্টির স্লোগানগুলো  প্রতি মুহূর্তে কাঁপিয়ে দিচ্ছে বাংলার আকাশ- বাতাস। বাঙালি বীরের জাতি, লড়াই করেই মরতে জানে তারা। পরাজয় না মানা এই তরুনেরা মিছিলটাকে এগিয়ে নিচ্ছে রক্তাক্ত সেই পথ ধরে। লাল -সবুজ পতাকার লাল বৃত্তটা যোদ্ধাদের রক্তে যেন আরও বেশি লাল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আর সবুজের মাঝে মিশে আছে চিরন্তন বাংলার প্রাণের স্পন্দন। সবুজের বুকে লাল, উড়বে চিরকাল। মিছিলটা এগিয়ে চলছে। চলছে স্লোগান, চলছে গণসংগীত। প্রতি ছত্রে ছত্রে, প্রতি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে এক একটি বিপ্লবের দিয়াশলাই। এক দিয়াশলাই থেকে আগুন ছড়িয়ে গেছে লক্ষ দিয়াশলাইয়ে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে বিপ্লবের সেই বহ্নিশিখা। স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালির চিরকালের প্রাণের স্পন্দন যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে আজ...
 
"রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই", "জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব", "তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা- মেঘনা- যমুনা", "ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার" - এ কি!!! এ কোন মিছিল? বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর,বিরানব্বই না শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর? স্লোগানগুলো সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে চারপাশে। আর সব স্লোগান ছাপিয়ে বাংলার আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে ভেসে আসছে সেই চিরন্তন শাশ্বত স্লোগান "জয় বাংলা"। এ মিছিল প্রাণের মিছিল। যুগে যুগে বাঙ্গালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সব বিপ্লবীরা আজ যেন এসে হাজির হয়েছে এই মিছিলে। ভেঙ্গে পরেছে সব বাধার প্রাচীর; মাথার উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া সাঁই সাঁই চাপাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাঙ্গালির মিছিল আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। প্রজন্ম চত্বর থেকে কারওয়ান বাজার, টি এস সি থেকে কাঁটাবন, রমনা থেকে শেরাটন কিংবা বাংলার প্রতিটা ঘরের প্রতিটা বাঙালি আজ শামিল এই মিছিলে। মিছিল এগিয়ে চলেছে; দিন নেই, রাত নেই। মিছিল এগিয়ে চলেছে স্বপ্নের সিঁড়ির সবার উপরের ধাপটির দিকে। বাংলাদেশকে আর কেউ কোনদিন হারাতে পারবে না। বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তরের যোদ্ধারা আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই মিছিলে। সন্ধ্যাপ্রদীপের বদলে বাংলার মেয়েদের হাতে আজ জ্বলন্ত মশাল। মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ আলোকিত হবে জাগরণের মশালে। স্লোগানগুলো ভিড় করে আসছে চারপাশ থেকে। একাল- সেকালের সীমানাকে ছাড়িয়ে শহীদ রফিক- শফিক- বরকত- জব্বার কিংবা শহীদ আসাদও আজ শামিল এই প্রাণের মিছিলে। মেজর খালেদ মোশাররফও আছেন, দেখছেন তাঁর পাগল ছেলেমেয়েদেরকে।

মিছিলটা এগিয়ে চলছে। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে ইতিহাস গড়ার পথে এগিয়ে চলছে সেই মিছিল। বাবার হাত ধরে শিশুটি আজ মিছিলে। মিছিলে এসেছে মায়ের হাত ধরে কিশোরী মেয়েটি। মিছিলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের টগবগে তরুন থেকে শুরু করে সবচেয়ে শান্ত ছেলেটিও। হুইলচেয়ারে করে চলা বোনটিও পারেনি ঘরে বসে থাকতে; সেও আজ শামিল এই প্রাণের জোয়ারে। শহীদের মৃত্যু নেই। তাই হারিয়ে যাননি শহীদ রুমী- বদি- আজাদ- জুয়েল- আলতাফ মাহমুদ কেউই। হারিয়ে যাননি মা জাহানারা ইমাম কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার মনের বিপ্লবী চেতনাতে আজও বেঁচে আছেন তাঁরা, চিরকাল বেঁচে থাকবেন। এক একটি বাংলা অক্ষর এক একটি বাঙ্গালির জীবন। বায়ান্ন সেই বাংলা অক্ষরকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছে পাকিস্তানি শাসকের কালো থাবার হাত থেকে। সেই বাংলা ভাষাকে বুকে আঁকড়ে ধরে স্বাধীনতার প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে জীবন দিয়েছেন শহীদ আসাদেরা। আর উনসত্তরের সেই শহীদদের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে আবার একাত্তরে এসে। বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঘরে বসে থাকেননি মা- বোনেরাও। কখনও সম্মুখসমরে, কখনও সেবা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। প্রতিটা বাঙালি নিজেদের সর্বস্বের বিনিময়ে একটা জিনিসই চেয়েছেন, আর তা হল স্বাধীনতা। একাত্তরে সন্তানহারা মা বিরানব্বইয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন রাজাকারের দম্ভ চিরকালের মত চূর্ণ করে দেয়ার প্রদীপ। আর এই সব ইতিহাসকে বুকে জড়িয়ে জেগে আছে  শাহবাগ। বিজয় মিছিলটা এগিয়ে চলছে; বাংলা মায়ের স্বাধীনতাবিরোধী হায়েনাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের আর বাঙ্গালির চূড়ান্ত বিজয়ের মিছিল...

মিছিলটা এগিয়ে চলছে নতুন এক আগামীর পথে। যে আগামীতে বাংলাদেশের জয়যাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না কোন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। হোক না বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ, হোক না বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মম ছোবলে আক্রান্ত, হোক না বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের এখনও নেই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের নিশ্চয়তা। কিন্তু তারপরেও মনে রাখতে হবে এই দেশের নাম "বাংলাদেশ"। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, মায়ের ভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য বারবার যারা জেগে উঠতে পারে দ্বিগুণ দারুন তেজে। এই যে পথশিশুটি হেঁটে যাচ্ছে তার দিকে চেয়ে দেখ, একাত্তরে নিজেদের জীবন মায়া তুচ্ছ করে ওর মত ছেলেরাই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ বহন করেছিল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এই যে পাতাকুরানি মেয়েটাকে দেখছ, ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখ সেও ছিল প্রজন্ম চত্বরের সমাবেশে, মিছিলে। এই যে সাধাসিধে তরুনটি রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, প্রশ্ন করে দেখ সে হয়ত সকাল থেকে না খেয়ে আছে, রক্ত খুঁজছে সম্পূর্ণ অচেনা কোন মানুষের জন্য। এরই নাম বাংলাদেশ। এখানের একেবারে সাধারণ মানুষেরাও দেশের প্রয়োজনে হয়ে উঠতে পারে অসাধারন। পুতুল খেলার হাতে তুলে নিতে পারে একে-৪৭, বই- খাতা ফেলে কিংবা সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়্তাকে নিজের হাতে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে ছুটে যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধে। মিছিলটা এগিয়ে চলছে। মশালের অগ্নিশিখাগুলো জ্বলে উঠছে দ্বিগুণ দারুণ তেজে। ইতিহাসের মিছিল আজ প্রদক্ষিণ করবে সারা বাংলাদেশ। লক্ষ কোটি কণ্ঠের বজ্ররুপ স্লোগানে চূর্ণ হয়ে গেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের সব দম্ভ।

এই দেশ বঙ্গবন্ধুর, শহীদজননীর, বীরাঙ্গনা মায়ের, মুক্তিযোদ্ধার, প্রজন্ম চত্বরের। এই দেশ বাঙ্গালির। এই দেশকে যে ভালোবাসে এই দেশ তার। এই দেশ কোন ঘাতক- রাজাকারের "না"। ইতিহাসকে ফিরে আসতেই হয়। তাই বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট, বারবার ফিরে আসে একাত্তর। মিছিল এগিয়ে চলে। অনাদিকাল থেকে এই মিছিল এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের জন্য। মিছিলে আজকে আবার ফিরে এসেছেন বায়ান্ন থেকে আজ পর্যন্ত সব শহীদেরা।শহীদ রফিক- শফিক- বরকত- জব্বার- শফিউর থেকে শহীদ আসাদ, শহীদ রুমী- বদি- আজাদ- আলতাফ মাহমুদ- জুয়েল কিংবা নাম না জানা অগণিত শহীদ থেকে শুরু করে শহীদ রাজীব, দীপ, জগতজ্যোতি, জাফর মুন্সি। বাংলার নদী, মাঠ, খেতকে ভালোবেসে হাজার বছর পরে আবার ফিরে এসেছেন এই বাংলায়। বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তর বিরানব্বই, দুই শূন্য এক তিন সব একাকার হয়ে গেছে চিরন্তন মুক্তির মিছিলে। আজ সব কটা জানালা খুলে দেয়ার দিন। আজ বিজয়ের গান গাইবার দিন। আজ লাল- সবুজ পতাকাটাকে বুকে জড়িয়ে পাগলের মত কাঁদার দিন। আজ জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে তোলার দিন। স্মৃতির মৃত্যু নেই। তাই প্রাণের মিছিল হয়ে এই বাংলায়  বারবার ফিরে আসে রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি। এই বাংলায় আবার ফিরে আসতেই হয় একাত্তরকে; কারণ শহীদ রুমীর বাঁধাই করা ছবিটার নিচে পরম মমতাভরে আম্মা যে লিখেছিলেন, "আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়..."

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন